আল্লাহু নিরাকার নন । আল্লাহর হাত, পা, আঙুল, মুখমণ্ডল (সিফাত বা গুণ) , ব্যাখ্যা ও দলিল বা রেফারেন্স সহ
কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ্ রব্বুল ‘আলামীনের আরও কিছু সত্তাগত সিফাত বর্ণিত হয়েছে। যেমন –
“তারা আল্লাহ্র যথার্থ মর্যাদা নিরুপণ করতে পারেনি। কিয়ামতের দিন সমগ্র পৃথিবী তাঁর হাতের মুঠোতে থাকবে, আর আকাশমণ্ডলী থাকবে ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে। মাহাত্ম্য তাঁরই, তারা যাদেরকে তাঁর শরিক করে, তিনি তার বহু উর্ধ্বে।” [সূরা যুমার (৩৯): ৬৭]
“হে ইবলিস, তোমাকে কোন জিনিসটি তাকে সেজদা করা থেকে বিরত রাখলো যাকে আমি স্বয়ং নিজের হাত দিয়ে বানিয়েছি? তুমি কি এমনি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কেউ?” [সূরা সোয়াদ (৩৮): ৭৫]
আব্দুলাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “আমার মহিমাময় প্রতিপালক সর্বোত্তম আকৃতিতে আমার নিকট আগমন করেন, তিনি বলেন, ‘হে মুহাম্মাদ!’ আমি উত্তর দিলাম, ‘উপস্থিত, হে আমার প্রভু! আমি আপনার হুকুমের দাস।’ তখন তিনি বলেন, ‘হে মুহাম্মাদ! তুমি কি জানো সর্বোচ্চ পরিষদ কোন বিষয়ে বিতর্ক করছে?’ আমি বললাম, ‘না।’ তখন তিনি তাঁর হাত আমার দুই কাঁধের মধ্যে রাখলেন, এমনকি আমি তার শীতলতা আমার বক্ষের মধ্যে অনুভব করলাম।’” [তিরমিযি,৩২৩৪ (হাসান)]
আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “ইয়াহুদি আলিমদের থেকে এক আলিম রাসূলুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে এসে বললো, ‘হে মুহাম্মাদ! আমরা (তাওরাতে) পাই যে, আল্লাহ তা’আলা আকাশসমূহকে এক আঙুলের উপর স্থাপন করবেন। জমিনকে এক আঙুলের উপর, বৃক্ষসমূহকে এক আঙুলের উপর, পানি এক আঙুলের উপর, মাটি এক আঙুলের উপর এবং অন্যান্য সৃষ্টিজগত এক আঙুলের উপর স্থাপন করবেন। তারপর বলবেন, আমিই বাদশাহ।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তা সমর্থনে হেসে ফেললেন, এমনকি তাঁর সামনের দাঁত প্রকাশ হয়ে পড়ে। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাঠ করলেন, ‘তারা আল্লাহ্র যথার্থ মর্যাদা নিরুপণ করতে পারেনি।’” [বুখারী, ৪৮৫৯]
আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, “আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমার প্রতিপালক আমার সাথে এই ওয়াদা করেছেন যে, তিনি আমার উম্মতের মধ্য হতে সত্তর হাজার লোককে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তাদের উপর কোনো আযাবও হবে না। আবার উক্ত প্রত্যেক হাজারের সাথে সত্তর হাজার এবং আমার প্রতিপালকের আরো তিন অঞ্জলি ভর্তি লোক জান্নাতে দিবেন।’” [ইবনু মাজাহ, ২৪৩৭ (হাসান)]
আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, “রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের অন্তরসমূহ আল্লাহর আঙুল সমূহের দুই আঙুলের মাঝে মাত্র একটি অন্তরের ন্যায় অবস্থিত। তিনি ইচ্ছামতো অন্তরের পরিবর্তন ঘটান।’ তারপর রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘হে অন্তরের আবর্তনকারী আল্লাহ! আমাদের অন্তরকে তোমার আনুগত্যের উপর আবর্তিত কর।’” [মুসলিম, ২৬৫৫]
“(কিয়ামতের দিন) ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। (হে রাসূল) আপনার মহিমাময় ও মহানুভব রবের চেহারা অর্থাৎ সত্ত্বাই একমাত্র বাকি থাকবে।” [সূরা আর-রহমান (৫৫): ২৬-২৭]
“ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। যেমন,
মহান আল্লাহ আরশে সমুন্নত হয়েছেন
“দয়াময় (আল্লাহ) আরশে সমুন্নত।” [সূরা ত্বা-হা (২০): ৫]
“নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক হচ্ছেন সেই আল্লাহ যিনি আসমান ও জমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হন।” [সূরা আ’রাফ (৭): ৫৪]
“আল্লাহই উর্ধ্বদেশে আকাশমণ্ডলী স্থাপন করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত- তোমরা এটা দেখছো। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হলেন।” [সূরা রা’দ (১৩): ২]
অন্য একটি হাদীসে ইবনে বাশার (রাঃ) বর্ননা করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ আরশের উপর। এবং তাঁর আরশ আসমানসমূহের উপর।” [আবুদাউদ, ৪৭২৬ (যয়ীফ)]
মহান আল্লাহ বিচার দিবসে হাশরের মাঠে আসবেন
“তারা কি সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে যে, মেঘের আড়ালে তাদের সামনে আসবেন আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ? আর তাতেই সব মীমাংসা হয়ে যাবে? বস্তুতঃ সব কার্যকলাপই আল্লাহর নিকট গিয়ে পৌঁছবে।” [সূরা বাক্বারাহ (২): ২১০]
উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইবনে কাসিরে উল্লেখ করা হয়েছে: ইমাম ইবনে জারীর (রহ) এখানে একটি দীর্ঘ হাদীস এনেছেন যার মধ্যে শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এর বর্ণনাকারী হচ্ছেন আবু হুরাইরা (রাঃ)। মুসনাদ ইত্যাদির মধ্যে এই হাদীসটি রয়েছে। এর মধ্যে বর্ণিত আছে যে, মানুষ যখন ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে, তখন তারা নবীদের (আঃ) নিকট সুপারিশের প্রার্থনা জানাবে। আদম (আঃ) থেকে নিয়ে এক একজন নবীর কাছে তারা যাবে এবং প্রত্যেকের কাছে পরিষ্কার জবাব পেয়ে ফিরে আসবে। অবশেষে তারা আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট পৌঁছবে। তিনি উত্তর দেবেন, ‘আমি প্রস্তুত আছি। আমিই তার অধিকারী।’ অতঃপর তিনি যাবেন এবং আরশের নিচে সিজদায় পড়ে যাবেন। তিনি আল্লাহ তা’আলার নিকট সুপারিশ করবেন যে, তিনি যেন বান্দাদের ফায়সালার জন্য আগমন করেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সুপারিশ কবুল করবেন এবং মেঘমালার ছত্রতলে সমাগত হবেন। দুনিয়ার আকাশও ফেটে যাবে এবং তাঁর সমস্ত ফেরেশতা এসে যাবে। দ্বিতীয় আকাশও ফেটে যাবে এবং তাঁর সমস্ত ফেরেশতা এসে যাবে। এভাবে সাতটি আকাশই ফেটে যাবে এবং সেগুলোর সমস্ত ফেরেশতা এসে যাবে। এরপর আল্লাহর আরশ নেমে আসবে এবং সম্মানিত ফেরেশতাগণ অবতরণ করবেন এবং স্বয়ং মহাশক্তিশালী আল্লাহ আগমন করবেন। সমস্ত ফেরেশতা তাসবীহ পাঠে লিপ্ত হয়ে পড়বেন।
কিয়ামতের বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ আরও বলেন,
“সেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে ও বিক্ষিপ্ত হবে। এবং ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আট জন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের উর্ধ্বে বহন করবে।” [সূরা আল-হাক্বক্বাহ (৬৯): ১৬-১৭]
আবু সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগে কতিপয় সাহাবী তাঁকে বলেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামত দিবসে আমরা কি আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবো?” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “হ্যাঁ।” তিনি আরো বললেন, “দুপুরে মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য অবলোকন করতে কি তোমাদের ধাক্কাধাক্কির সৃষ্টি হয়?” সকলে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! না, তা হয় না।” নাবী (সাঃ) বললেন, “ঠিক তদ্রুপ কিয়ামত দিবসে তোমাদের প্রতিপালককে অবলোকন করতে কোনোই বাধার সৃষ্টি হবে না। সেদিন এক ঘোষণাকারী ঘোষণা দিবে, ‘যে যার উপাসনা করতে, সে আজ তার অনুসরণ করুক।’ তখন আল্লাহ ব্যতীত যারা অন্য দেব-দেবী ও বেদীর উপাসনা করতো, তাদের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না; সকলেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। সৎ হোক বা অসৎ, যারা আল্লাহর ইবাদাত করতো, তারাই কেবল অবশিষ্ট থাকবে এবং কিতাবীদের যারা দেব-দেবী ও বেদীর উপাসক ছিলো না, তারাও বাকি থাকবে। এরপর ইহুদীদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হবে, ‘তোমরা কার ইবাদাত করতে?’ তারা বলবে, ‘আল্লাহর পুত্র উযায়েরের।’ তাদেরকে বলা হবে, ‘মিথ্যা বলছো। আল্লাহ কোনো পত্নী বা সন্তান গ্রহণ করেননি। তোমরা কী চাও?’ তারা বলবে, ‘হে আল্লাহ! আমাদের খুবই পিপাসা পেয়েছে। আমাদের পিপাসা নিবারণ রুকন।’ প্রার্থনা শুনে তাদেরকে ইঙ্গিত করে মরীচিকাময় জাহান্নামের দিকে জমায়েত করা হবে। এর একাংশ আরেক অংশকে গ্রাস করতে থাকবে। তারা এতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এরপর খ্রীষ্টানদেরকে ডাকা হবে। বলা হবে, ‘তোমরা কার ইবাদাত করতে?’ তারা বলবে, ‘আল্লাহর পুত্র মসীহের উপাসনা করতাম।’ বলা হবে, ‘মিথ্যা বলছো। আল্লাহ কোনো পত্নী বা সন্তান গ্রহণ করেননি।’ জিজ্ঞেস করা হরে, ‘এখন কী চাও?’ তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের দারুণ তৃষ্ণা পেয়েছে, আমাদের তৃষ্ণা নিবারণ করুন।’ তখন তাদেরকেও পানির ঘাটে যাবার ইঙ্গিত করে জাহান্নামের দিকে জমায়েত করা হবে। একে মরীচিকার মতো মনে হবে। এর এক অংশ অপর অংশকে গ্রাস করে নিবে। তারা তখন জাহান্নামে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকবে। শেষে মুমিন হউক বা গোনাহগার, এক আল্লাহর উপাসক ব্যতীত আর কেউ (ময়দানে) অবশিষ্ট থাকবে না। তখন আল্লাহ তাদের কাছে আসবেন। বলবেন, ‘সবাই তাদের স্ব স্ব উপাস্যের অনুসরণ করে চলে গেছে, আর তোমরা কার অপেক্ষা করছো?’ তারা বলবে, ‘হে আমাদের প্রভু! যেখানে আমরা বেশি মুখাপেক্ষী ছিলাম, সেই দুনিয়াতে আমরা অপরাপর মানুষ থেকে পৃথক থেকেছি এবং তাদের সঙ্গী হইনি।’ তখন আল্লাহ বলবেন, ‘আমিই তো তোমাদের প্রভু।’ মুমিনরা বলবে, ‘আমরা তোমার থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহর সঙ্গে আমরা কিছুই শরীক করি না।’ এই কথা তারা দুই বা তিনবার বলবে। এমন কি কেউ কেউ অবাধ্যতা প্রদর্শনেও অবতীর্ণ হয়ে যাবে। আল্লাহ বলবেন, ‘আচ্ছা, তোমাদের কাছে এমন কোনো নিদর্শন আছে যা দ্বারা তাঁকে তোমরা চিনতে পারো?’ তারা বলবে, ‘অবশ্যই আছে।’ এরপর ‘সাক’ (পায়ের গোছা) উন্মোচিত হবে। তখন পৃথিবীতে যারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করতো, তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা সিজদা করার অনুমতি দিবেন। আর যারা লোক দেখানো বা লোকভয়ে আল্লাহকে সিজদা করতো, সে মুহূর্তে তাদের মেরুদন্ড শক্ত ও অনমনীয় করে দেওয়া হবে। যখনই তারা সিজদা করতে ইচ্ছা করবে, তখনই তারা চিত হয়ে পড়ে যাবে। তারপর তারা মাথা তুলবে। ইত্যবসরে তারা আল্লাহকে প্রথমে যে আকৃতিতে দেখেছিলো তাতে পরিবর্তিত হয়ে যাবে (তিনি তাঁর আসল রুপে আবির্তূত হবেন)। অনন্তর বলবেন, ‘আমি তোমাদের রব।’ তারা বলবে, ‘হ্যাঁ, আপনি আমাদের প্রতিপালক।’” [মুসলিম, ১৮৩]
জান্নাতে মুমিনগণ মহান আল্লাহ্র দর্শন লাভ করবে।
মহান আল্লাহ বলেন,
“সেদিন কোনো কোনো মুখ খুব উজ্জ্বল হবে। তারাই হবে তাদের প্রতিপালকের দর্শনকারী।” [সূরা ক্বিয়ামাহ (৭৫): ২২-২৩]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ওইদিন এমন হবে, যাদের মুখমণ্ডলে উজ্জ্বলতা প্রকাশ পাবে, তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
তিনি পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “আমাদের পালনকর্তা মহান আল্লাহ প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে নিম্নতম আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, ‘আমি মালিক, আমিই মালিক। কে আছো আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেবো? কে আছো আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করবো? কে আছো আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো?’ এভাবে তিনি ফজর স্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত আহবান করেন।” [মুসলিম, ৭৫৮]
তিনউল্লেখিত আয়াত এবং হাদীসগুলোতে আমরা দেখি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নিজের সত্তার সাথে সুরাত (আকার, আকৃতি, রুপ), ওয়াজহুন (চেহারা), ইয়াদুন (হাত), কদামুন (পা), আইনুন (চোখ) ইত্যাদি সিফাত সম্পর্কিত করেছেন। আবার আল্লাহর ইস্তাওয়া (সমুন্নত হওয়া), আতা (আসা) ও নাঝালা (অবতরণ করা) ইত্যাদি তাঁর কর্মগত সিফাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অথচ আমরা ছোটবেলা থেকে বলে আসছি ‘কুদরতী হাত’, ‘কুদরতী পা’, ‘কুদরতী চোখ’। আবার ‘তাঁর আসা’ বলতে স্বয়ং তাঁর সত্তার আগমন না বলে ‘করুণা বা রহমত’ নাযিলের কথা বলছি। অর্থাৎ আমরা আল্লাহ্ সম্পর্কে ঠিক সেভাবে বলছি না যেভাবে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। উপরন্তু সেগুলোকে ভিন্ন অর্থে তাবীল (ব্যাখ্যা) করছি।
আল্লাহর সিফাতকে রূপক অর্থ করার এই রীতি ‘আশারী ও মাতুরিদি আকিদা’ বলে পরিচিত। মহান আল্লাহর সত্তাগত গুণাবলী সম্পর্কে দেওবন্দ মাদ্রাসার নেতৃস্থানীয় আলিম মাওলানা খলিল আহমেদ শাহরানপুরি (রহঃ) ১৩২৫ হিজরী সালে উলামায়ে দেওবন্দের পক্ষ হয়ে আল-মুহান্নাদ আলা মুফান্নাদ আকাঈদ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাহ কিতাবে বলেন, “আমরা আমাদের জামাত শরীয়তের সকল বিধান প্রবিধানে আল্লাহর ইচ্ছায় ইমাম আযম আবু হানিফা (রহঃ) এর অনুসারী। আক্বীদায় আমরা আবুল হাসান আল-আশারী ও আবু মনসুর মাতুরিদির অনুসারী। সুফি তরিকায় আমরা নাখশাবন্দীয়া, চিশতিয়া, সেহরাওয়ারদিয়া ও মুজাদ্দেদিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখি।”
তিনি আরও বলেন, “এবং আমাদের ইমামগণ কুরআনের (কিছু) আয়াতকে সঠিক ভাষায় ও শারিয়া সাপেক্ষে গ্রহনীয় তাবিল (রুপক ব্যাখ্যা) করেছেন, যাতে আমাদের মতো সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্নরা বুঝতে পারে। উদাহরণস্বরুপ ‘ইসতাওয়া (সমুন্নতহওয়া)’-কে ‘জয় করা’ বা ‘দখল করা’ (conquer, over power) এবং ‘ইয়াদ (হাত)’-কে ‘ক্ষমতা’ (power) অর্থ করা। সুতরাং, আমরাও তা-ই সঠিক মনে করি।”
ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‘আরী (মৃ.৩২৪হি.) জীবনের একপর্যায়ে আল্লাহর যাবতীয় গুণাবলীর মধ্য থেকে কেবল শ্রবণ, দর্শন, ইচ্ছা, সামর্থ্য, কথা, জ্ঞান ও জীবন- এ সাতটি গুণকে স্বীকার করে অবশিষ্ট যাবতীয় গুণাবলী, যেমন- ইসতেওয়া বা উপরে উঠা, অবতরণ, আগমন করা, হাসা, সন্তুষ্ট হওয়া, ভালোবাসা, অপছন্দ করা, রাগান্বিত ও আনন্দিত হওয়া, এসব গুণাবলীর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ না করে এগুলোর তা’বীল বা ব্যাখ্যা করেন।
আশারী পণ্ডিতগনের মধ্যে ইমাম ইবনে জারির আল-তাবারী আরশে সমুন্নত হওয়াকে আরশের উপর ক্ষমতা ও সার্বভৌমিকতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অধিষ্ঠিত হওয়া বুঝিয়েছেন, স্থানান্তরের মাধ্যমে নয়। অন্যান্যরা যারা ‘ইস্তাওয়া’-কে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন, তাদের মধ্যে ইমাম আল বায়হাকী, ইমাম-আল হারামাইন আললুওয়ানী, ইমাম রাগিব আল ইস্ফাহানী, ইমাম গাজ্জালী, আবু ফরাজ ইবনে আলজাজী আল হাম্বলী, ইমাম ফাখরুদ্দীন আররাযী, ইমাম বায়যাবী, ইমাম নাসাফী, ত্বকীউদ্দিন সুবকী, ইমাম ইবনে আলহুমান আল হানাফী, ইমাম সুইয়ুতী উল্লেখযোগ্য।
তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, যার নামে এই মতবাদ প্রচলিত রয়েছে, সেই ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‘আরী তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্বমত পরিহার করে সালাফগণের মতের পূর্ণ অনুসরণ করেছিলেন। মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়াত উদ্দিন তাঁর ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণের পৃ-৪১ এ বলেন, “ইমাম আবুল হাসান আল আশারী (র) প্রথম দিকে কুরআন ও হাদীসে উল্লেখিত সিফাতগুলোর ক্ষেত্রে রূপক অর্থ গ্রহন করতেন, তবে পরবর্তীতে তিনি সালাফে সালেহিনের ন্যায় রূপক বর্ননা (তাবিল) ছাড়াই বিশ্বাসের পন্থা অবলম্বন করেন।”
ইমাম আবুল হাসান আল-আশারী আল ইবানাহ আন উসুল আদ-দিয়ানাহ এবং মাক্বালাত আ ইসলামিয়িন কিতাবদ্বয়ে এ ব্যাপারটি উল্লেখ করেন।
মূলত তাবীল হচ্ছে কালাম শাস্রীয় পণ্ডিতগনের (মুতাকাল্লিমিন) অনুসৃত পন্থা। যেমন, মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহঃ) এর তাফসির মাআরেফুল কুরআন এ সূরা ঝুমারের ৬৭ নং আয়াত [কিয়ামতের দিন সমগ্র পৃথিবী তাঁর হাতের মুঠোতে থাকবে, আর আকাশমণ্ডলী থাকবে ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে।] এর ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছে যে “পূর্ববর্তী” আলেমগণ আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করতেন এবং “পরবর্তী” আলেমগণ রূপক সাব্যস্ত করে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন,
“কেয়ামতের দিন পৃথিবী আল্লাহর মুঠিতে থাকবে এবং আকাশ ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে থাকবে। পুর্ববর্তী আলেমগণের মতে আক্ষরিক অর্থেই এমনটি হবে। কিন্তু আয়াতের বিষয়বস্তু মুতাশাবিহাতের অন্তর্ভুক্ত, যার স্বরূপ আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। এর স্বরূপ জানার চেষ্টা করাও সাধারণ লোকের জন্য নিষিদ্ধ। বিশ্বাস করতে হবে যে আল্লাহর যা উদ্দেশ্য তা সত্য ও বিশুদ্ধ। এই আয়াতের বাহ্যিক ভাষ্য থেকে জানা যায় যে আল্লাহ তা’আলার ‘মুঠি’ ও ‘ডান হাত’ আছে। এগুলো দৈহিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, অথচ আল্লাহ তা’আলা দেহ ও দেহত্ব থেকে পবিত্র ও মুক্ত। তাই আয়াতের উপসংহারে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে এগুলোকে নিজেদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আলোকে বুঝতে চেষ্টা করো না। আল্লাহ এগুলো থেকে পবিত্র। পরবর্তী আলেমগণ আলোচ্য আয়াতকে দৃষ্টান্ত ও রূপক সাব্যস্ত করে এর অর্থ করেছেন যে ‘এ বস্ত আমার মুঠি ও ডান হাতে’ এরূপ বলে রূপক ভঙ্গিতে বোঝানো হয় যে বস্তুটি পূর্ণরুপে আমার করায়ত্ব ও নিয়ন্ত্রনাধীন। আয়াতে তা-ই বোঝানো হয়েছে।”
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘তাফসির ইবনে কাসিরে’ বলা হয়েছে,
“এ ধরনের আয়াতের ব্যাপারে পূর্বযুগীয় সৎ লোকদের নীতিও এটাই ছিলো যে, যেভাবে এবং যে ভাষায় ও শব্দে এটা এসেছে, সেভাবেই এবং সেই শব্দগুলোর সাথেই তাঁরা এটা মেনে নিতেন। এর অবস্থা তাঁরা অনুসন্ধান করতেন না এবং তাতে কোনো পরিবর্তন পরিবর্ধনও করতেন না। এই আয়াতের তাফসিরে সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, ইহুদী আলিমদের থেকে জনৈক আলিম রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এসে বললো, “হে মুহাম্মাদ! আমরা (তাওরাতে দেখতে) পাই যে, আল্লাহ তা’আলা আকাশসমূহকে এক আঙুলের উপর স্থাপন করবেন। জমিনকে এক আঙুলের উপর, বৃক্ষসমূহকে এক আঙুলের উপর, পানি এক আঙুলের উপর, মাটি এক আঙুলের উপর এবং অন্যান্য সৃষ্টিজগত এক আঙুলের উপর স্থাপন করবেন। তারপর বলবেন, ‘আমিই বাদশাহ্।’” রাসূল (সাঃ) তা সমর্থনে হেসে ফেললেন; এমনকি তাঁর সামনের দাঁত প্রকাশ হয়ে পড়ে। এরপর রাসূল (সাঃ) পাঠ করলেন, “তারা আল্লাহর যথোচিত সম্মান করে না।” মুসনাদে আহমাদে হাদীসটি প্রায় এভাবেই বর্ণিত আছে। তাতে আছে যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হেসে ওঠেন এবং আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। আর একটি রেওয়াতে আছে যে ওই ইয়াহুদি আলেম কথা বলার সময় নিজের আঙুলির প্রতি ইশারা করেছিলো। প্রথমে সে তার তর্জনী আঙুলের উপর ইশারা করেছিলো।”
আর কয়েকটি ক্ষেত্রে সালাফদের কেউ কেউ রুপক অর্থ করেছেন যা আরবি ভাষা রিতি বা বাক্য বিন্যাস হিসেবে যথার্থ এবং সব ভাষাই এমন রুপক অর্থের ব্যবহার রয়েছে। যেমনঃ كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ “আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সবকিছু ধবংস হবে।” [সূরা ক্বাসাস (২৮): ৮৮] ইমাম বুখারী এখানে ‘ওয়াজহ’ (মুখ) কে ‘মূলক’ (সাম্রাজ্য) দ্বারা তাবীল করেছেন। অন্যভাবে ইখলাসপূর্ণ কাজ বলেছেন। আবু উবায়দা এখানে ‘মর্যাদা’ করেছেন।[১]
অনুরূপভাবে, “গোছা পর্যন্ত পা খোলার দিনের কথা স্মরণ কর, সেদিন তাদেরকে সেজদা করতে আহবান জানানো হবে, অতঃপর তারা সক্ষম হবে না।” [সূরা ক্বলাম (৬৮): ৪২] আয়াতে উল্লেখিত “পায়ের গোছা”কে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) “কাঠিন্য” বলে ব্যাখ্যা করেছেন।[২]
এমনিভাবে আল্লাহর হাত কিছু ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য হিসেবে এসেছে। এবং এসব ক্ষেত্রে বাক্যের বর্ণনা ও ক্ষেত্র সঠিক অর্থ গ্রহণে সাহায্য করে। মোট কথা কিছু ক্ষেত্রে রুপক অর্থ নেওয়া খুবই স্বাভাবিক।
সিফাতগুলো ব্যখ্যাহীনভাবে গ্রহণের অসংখ্য নির্দেশনার মধ্যে এ ধরনের স্বাভাবিক ভাষার ব্যবহারগত উদাহরণকে অন্য সব সিফাতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। কেননা তাঁরাও অন্যত্র সিফাতগুলোর ব্যখ্যা করতে নিষেধ করেছেন এবং তা পূর্ববর্তী উলামাদের ইজমা বিরোধী। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হাসান শায়বানী (রহঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন,
“পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সকল দেশের ফকীহগণ একমত যে, মহান আল্লাহর বিশেষণ সম্পর্কে কুরআন ও সহীহ হাদীসে বিশ্বাস করতে হবে কোনোরূপ পরিবর্তন বিশেষায়ণ বা তুলনা ব্যতিরেকে। যদি কেউ বর্তমানে সেগুলোর কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করে, তবে সে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পথ ত্যাগকারী এবং উম্মাহর পূর্ববর্তীদের ইজমার বিরোধিতায় লিপ্ত। কারণ, তাঁরা এগুলোকে বিশেষায়িত করেন নি এবং ব্যাখ্যাও করেন নি।”[৩]
এক কথায় সালাফদের মূলনীতি এই যে, কুরআন ও সহীহ হাদীসে আল্লাহর নাম ও সিফাতের বিষয়ে যা কিছু বলা হয়েছে, তা সরল ও স্বাভাবিক অর্থে বিশ্বাস করা, আল্লাহর কোনো নাম, কর্ম বা বিশেষণকে সৃষ্টির নাম, কর্ম বা বিশেষণের সাথে তুলনা করা পরিহার করা এবং সাথে সাথে আল্লাহর নাম, কর্ম বা বিশেষণের সরল ও স্বাভাবিক অর্থের বাইরে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করা বর্জন করা। যেমন কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন। আবার পাশাপাশি মহান আল্লাহর শ্রবণ, দর্শন, কথোপকথন, হস্ত, মুখমণ্ডল, আরশের উপর সমুন্নত হওয়া, ক্রোধান্বিত হওয়া, সন্তুষ্ট হওয়া ইত্যাদি বিশেষণ ও কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কুরআন বা হাদীসে যে বিষয় উল্লেখ করা হয়নি, সে বিষয় আকীদার অন্তর্ভুক্ত না করা এবং সে বিষয়ে বিতর্কে না জড়ানো। কারণ মানুষ সৃষ্টি জগতের বাইরে চিন্তা করতে পারে না আর মহান আল্লাহ্কে সৃষ্ট কোন কিছুর দ্বারা অনুভব করা সম্ভব নয়। তাঁর সমস্ত গুণাবলী (সত্তাগত কিংবা কর্মগত) সৃষ্ট জগতের থেকে ভিন্ন, কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়।
আল্লাহর সিফাত সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন,
তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির কোনো কিছুর মত নন। তিনি অনাদিকাল থেকে অনন্তকাল বিদ্যমান রয়েছেন তাঁর নামসমূহ এবং তাঁর যাতী (সত্তার সাথে সংশিষ্ট) ও ফি’লী (কর্মমূলক) সিফাতসমূহ-সহ।
তাঁর যাতী বা সত্তাগত সিফাতসমূহ:
হায়াত (জীবন), কুদরাত (ক্ষমতা), ইলম (জ্ঞান), কালাম (কথা), সাম’ (শ্রবণ), বাসার (দর্শন) ওইরাদা (ইচ্ছা)। আর তাঁর ফি’লী বা কর্মবাচক সিফাতসমূহের মধ্যে রয়েছে: সৃষ্টি করা, রিয্ক প্রদান করা, নবসৃষ্টি করা, উদ্ভাবন করা, তৈরি করা এবং অন্যান্য কর্মমূলক সিফাত বা বিশেষণ। তিনি তাঁর গুণাবলি এবং নামসমূহ-সহ অনাদি-অনন্তরূপে বিদ্যমান। তাঁর নাম ও বিশেষণের মধ্যে কোনো নতুনত্ব বা পরিবর্তন ঘটেনি।
তাঁর সকল বিশেষণই মাখলুকদের বা সৃষ্ট প্রাণীদের বিশেষণের বিপরীত বা ব্যতিক্রম। তিনি জানেন, তবে তাঁর জানা আমাদের জানার মতো নয়। তিনি ক্ষমতা রাখেন, তবে তাঁর ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মতো নয়। তিনি দেখেন, তবে তাঁর দেখা আমাদের দেখার মতো নয়। তিনি কথা বলেন, তবে তাঁর কথা বলা আমাদের কথার মতো নয়। তিনি শুনেন, তবে তাঁর শোনা আমাদের শোনার মতো নয়।
তাঁর ইয়াদ (হস্ত) আছে, ওয়াজহ (মুখমণ্ডল) আছে, নফস (সত্তা) আছে, কারণ আল্লাহ কুরআনে এগুলো উলেখ করেছেন। কুরআন কারীমে আল্লাহ যা কিছু উল্লেখ করেছেন, যেমন মুখমণ্ডল, হাত, নফস ইত্যাদি সবই তাঁর বিশেষণ কোনোরূপ ‘স্বরূপ’, কীরূপ, প্রকৃতি বা কীভাবে তা নির্ণয় ব্যতিরেকে। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর ক্ষমতা অথবা তাঁর নিয়ামত। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর সিফাত বা বিশেষণ বাতিল করে দেওয়া। এরূপ ব্যাখ্যা করা কাদারীয়া ও মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের মানুষদের রীতি। বরং তাঁর হাত তাঁর বিশেষণ (সিফাত), কোনো স্বরূপ নির্ণয় ব্যতিরেকে। তাঁর ক্রোধ এবং তাঁর সন্তুষ্টি তাঁর দুটি বিশেষণ (সিফাত), আল্লাহর অন্যান্য বিশেষণের মতোই, কোনোরূপ কীরূপ, কীভাবে বা কেমন করে প্রশ্ন করা ছাড়াই।[৪]
ইমাম শাফেয়ীর ছাত্র এউনুস ইবনে আব্দুল আলা বলেন, “আবু আব্দুল্লাহ শাফিয়ীকে আল্লাহর সিফাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তখন তিনি বললেন,
আল্লাহর নাম ও সিফাত রয়েছে। কুরআনে সেগুলো আছে এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সেগুলো উল্লেখ করেছেন। যার কাছে তা প্রমাণিত হয়েছে, তার জন্য তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কুরআন ও সহীহ সূত্রে সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার পরও যদি কোনো ব্যক্তি বিরোধিতা করে, তবে সে অবশ্যই কাফির বলে গণ্য হবে। তবে যদি কেউ তার কাছে তা প্রমাণিত হওয়ার আগে বিরোধিতা করে, তবে সে ব্যক্তি অজ্ঞতার কারণে ওজর অব্যহতির যোগ্য। কারণ এ বিষয়ক জ্ঞান মানবীয় বুদ্ধি-বিবেক, যুক্তি, গবেষণা ও চিন্তাভাবনার মাধ্যমে অর্জন করা যায় না। কাজেই কারো নিকট এ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের সংবাদ পৌঁছানোর আগে এ বিষয়ক অজ্ঞতার কারণে আমরা কাউকে কাফির বলে গণ্য করি না। আমরা এ সকল বিশেষণ প্রমাণ ও বিশ্বাস করি এবং এগুলি থেকে তুলনা বাতিল ও অস্বীকার করি। কারণ মহান আল্লাহ নিজেই নিজের তুলনীয় হওয়ার বিষয়টি বাতিল করে বলেছেন, “কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়; তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা”[৫]
ইমাম আহমাদকে কারাগারের মধ্যে খলিফা মুতাসিমের সম্মুখে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। বিচারপতি আহমাদ ইবনে আবু দুয়াদ ও অন্যান্য মুতাজিলি পণ্ডিতগণ খলিফার সামনে ইমাম আহমদের সাথে বিতর্ক করেন। তিনি তাঁদেরকে বার বার বলেন, “আপনারা যে আকিদা দাবী করছেন তার পক্ষে কুরআন বা হাদীস থেকে অন্তত একটি বক্তব্য প্রদান করুন। কুরআন হাদীস বা সাহাবিদের বক্তব্য থেকে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করুন যাতে বলা হয়েছে কুরআন সৃষ্ট, আখিরাতে আল্লাহকে দেখা যাবে না, অথবা মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক বক্তব্যগুলোকে প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা যাবে না।” মুতাজিলিগণ বিভিন্ন আকলি প্রমাণ পেশ করেন। ইমাম আহমাদ সেগুলো খণ্ডন করেন এবং কুরআন বা হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করার দাবীতে অটল থাকেন। তখন বিচারপতি আহমাদ ইবনে আবু দুয়াদ বলেন, “হে আমিরুল মুমিনিন! এ ব্যক্তি একজন মুশরিক। একে হত্যা করুন, এর রক্তের দায় আমি বহন করবো। এসময় তাঁকে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করা হয় …[৬]
চার
আল্লাহ তা’আলার সত্তাগত অবস্থান
মহান আল্লাহ সত্তাগতভাবে সর্বত্র বিরাজমান নন বরং তাঁর জ্ঞান, দর্শন, শ্রবন ও ক্ষমতা সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর পবিত্র মহান সত্তা সৃষ্টির সত্তা থেকে পৃথক। তিনি সাত আসমানের উপর আরশে সমুন্নত এবং সেখান হতে ইচ্ছানুযায়ী অবতরণ করেন। মহান আল্লাহ্ বলেন,
“নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক হচ্ছেন সেই আল্লাহ, যিনি আসমান ও জমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হন।” [সূরা আ’রাফ (৭): ৫৪]
উক্ত আয়াতের তাফসিরে মাআরেফুল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ “অতঃপর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হলেন। ইস্তাওয়া এর শাব্দিক অর্থ অধিষ্ঠিত হওয়া। ‘আরশ’ রাজ সিংহাসনকে বলা হয়। এখন আল্লাহর ‘আরশ’ কীরূপ এবং কী, এর উপর অধিষ্ঠিত হওয়ার অর্থই বা কী? এ সম্পর্কে নির্মল, পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ মাযহাব সাহাবী ও তাবেয়ীদের কাছ থেকে এবং পরবর্তীকালে সুফি বুযুর্গদের কাছ থেকে এরূপ বর্ণিত হয়েছে যে, মানব জ্ঞান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর স্বরূপ সম্পূর্ণ বুঝতে অক্ষম। এর অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হওয়া অর্থহীন ও ক্ষতিকরও বটে। এ সম্পর্কে সংক্ষেপে এরূপ বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত যে, এসব বাক্যের যে অর্থ আল্লাহ তা’আলার উদ্দিষ্ট, তা-ই শুদ্ধ ও সত্য। এরপর নিজে কোনো অর্থ উদ্ভাবন করার চিন্তা করাও অনুচিত।
ইমাম মালেক (রহঃ)-কে কেউ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন, ইস্তাওয়া শব্দের অর্থ তো জানাই আছে, কিন্তু এর স্বরূপ ও অবস্থা মানব বুদ্ধি সম্যক বুঝতে অক্ষম। এতে বিশ্বাস করা ওয়াজিব। এর অবস্থা ও স্বরূপ জিজ্ঞেস করা বিদয়াত। কেননা সাহাবাগণ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এই ধরনের প্রশ্ন করেননি। সুফিয়ান সাওরী, ইমাম আওয়াযী, লায়েস ইবনে সাদ, সুফিয়ান ইবন ওয়াইনা, আব্দুল্লাহ ইবন মোবারক (রহঃ) প্রমুখ বলেছেন, যে সব আয়াতে আল্লাহ তা’আলার সত্তা ও গুনাবলী সম্পর্কে বর্ণিত আছে, সেগুলোর প্রতি যেভাবে আছে সেভাবে রেখেই কোনোরূপ ও সদর্থ ছাড়াই বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত। -(মাযাহারী)”
তাফসির ইবনে কাসিরে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “এই ছয়দিনের ব্যস্ততার পর আল্লাহ তা’আলা আরশের উপর সমুন্নত হন। এ স্থানে লোকেরা বহু মতামত পেশ করেছেন এবং বহু জল্পনা কল্পনা করেছেন। এগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ এখানে নেই। এ ব্যাপারে আমরা শুধুমাত্র পূর্ববর্তী গুরুজনদের মাযহাব অবলম্বন করেছি। তাঁরা হচ্ছেন মালিক, আওয়াযী, সাওরী, লায়েস ইবনে সাদ, শাফিঈ, আহমাদ, ইসহাক ইবনে রাহওইয়াই প্রমুখ নবীন ও প্রবীণ ইমামগন। আর ওই মাযহাব হচ্ছে এই যে কোনো অবস্থা ও সাদৃশ্য ছাড়াই ওটার উপর বিশ্বাস করতে হবে। কোনো জল্পনা কল্পনা করাও চলবে না যার দ্বারা সাদৃশ্যের আকিদা মস্তিস্কে এসে যায়। এটা আল্লাহ তা’আলার গুণাবলী হতে বহু দূরে। মোটকথা, যা কিছু আল্লাহ তা’আলা বলেছেন ওটাকে কোনো খেয়াল ও সন্দেহ ছাড়াই মেনে নিতে হবে কোন চুলচেরা করা চলবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা কোনো কিছুর সাদৃশ্যপূর্ণ নন। তিনি হচ্ছেন শ্রোতা ও দ্রষ্টা। যেমন মুজতাহিদ এবং চিন্তাবিদগণ বলেছেন। এদের মধ্যে নুয়াইম ইবনে হাম্মাদ আল খুযায়ী (রহঃ) ও রয়েছেন যিনি ইমাম বুখারীর উস্তাদ। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করলো, সে যেন কুফরী করলো। আর আল্লাহ তা’আলা নিজের সম্বন্ধে যা বলেছেন, তা যে ব্যক্তি অস্বীকার করলো, সে যেন কুফরী করলো। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) যেসব গুণে নিজেকে ভূষিত করেননি, সেসব গুণে তাঁকে ভূষিত করাই হচ্ছে তাঁর সাদৃশ্য স্থাপন করা। কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ওই সমস্ত গুণ সাব্যস্ত করে, যা স্পষ্টরুপে তাঁর আয়াতসমূহের মধ্যে ও বিশুদ্ধ হাদীসগুলোর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে এবং যা দ্বারা তাঁর মহিমা প্রকাশ পেয়েছে ও তাঁর সত্তাকে সর্বপ্রকার ত্রুটি থেকে মুক্ত করেছে, সেই ব্যক্তিই সঠিক খেয়ালের উপর আছে।”
মহান আল্লাহ্ আরও বলেন,
“দয়াময় (আল্লাহ) আরশে সমুন্নত।” [সূরা ত্বা-হা (২০): ৫]
“আল্লাহই উর্ধ্বদেশে আকাশমণ্ডলী স্থাপন করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত- তোমরা এটা দেখছো। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হলেন।” [সূরা রা’দ (১৩): ২]
“তিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেন; অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হন।” [সূরা ফুরক্বান (২৫): ৫৯]
“তিনিই ছয় দিনে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন।” [সূরা আল-হাদীদ (৫৭): ৪]
“তোমরা কি (এ বিষয়ে) নিরাপদ হয়ে গেছো যে, যিনি আকাশের উপর রয়েছেন তিনি তোমাদের সহ ভূমিকে ধসিয়ে দিবেন না? আর তখন ওটা আকস্মিকভাবে থরথর করে কাঁপতে থাকবে।” [সূরা মুলক (৬৭): ১৬]
ইবনে আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, তিনি হলেন আল্লাহ।[৭]
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিছু সৃষ্টিকে উপরে উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
“বরং আল্লাহ তাঁকে (ঈসাকে) নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন।” [সূরা নিসা (৪): ১৫৮]
“যারা আরশ বহন করে এবং যারা তাঁর চারপাশে আছে, তারা তাদের পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করে, তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আপনার রহমত ও জ্ঞান সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। অতএব, যারা তওবা করে এবং আপনার পথে চলে, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।” [সূরা আল-মু’মিন (৪০): ৭]
“আপনি ফেরেশতাগণকে দেখবেন, তারা আরশের চারপাশ ঘিরে তাদের পালনকর্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছে। তাদের সবার মাঝে ন্যায়বিচার করা হবে। বলা হবে, সমস্ত প্রশংসা বিশ্বপালক আল্লাহর। [সূরা যুমার (৩৯): ৭৫]
অন্য একটি হাদীসে ইবনে বাশার (রাঃ) বর্ননা করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ আরশের উপর। এবং তাঁর আরশ আসমানসমূহের উপর।” [আবুদাউদ, ৪৭২৬ (যয়ীফ)]
আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, যয়নব (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর অন্যান্য স্ত্রীগণের উপর গর্ব করে বলতেন যে, “তাঁদের বিয়ে তাঁদের পরিবার দিয়েছে, আর আমার বিয়ে আল্লাহ সপ্ত আসমানের উপর থেকে সম্পাদন করেছেন।” [বুখারী, ৭৪২০]
মু‘আবিয়া বিন আল-হাকাম আস-সুলামী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,আমার একজন দাসী ছিলো। ওহুদ ও জাওয়ানিয়্যাহ নামক স্থানে সে আমার ছাগল চড়াতো। একদিন দেখি, নেকড়ে আমাদের একটি ছাগল ধরে নিয়ে গেছে। আমি একজন আদম সন্তান। তারা যেভাবে ক্রুদ্ধ হয়, আমিও সেভাবে ক্রুদ্ধ হই। কিন্তু আমি তাকে এক থাপ্পড় মারি। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-এর নিকট আসলে একে আমি সাংঘাতিক (অন্যায়) কাজ বলে গণ্য করি। তাই আমি বলি যে, “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি কি তাকে আযাদ করবো না?” তিনি বললেন, “তাকে আমার নিকট নিয়ে আসো।” আমি তাকে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসলাম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আল্লাহ কোথায়?” সে বললো, “আসমানে।” তিনি (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি কে?” তখন সে বললো, “আপনি আল্লাহর রাসূল।” তখন নবী করীম (সাঃ) বললেন, “তাকে মুক্তি দিয়ে দাও, কারণ সে একজন ঈমানদার নারী।” [মুসলিম, ৫৩৭]
ইসরা ও মি‘রাজ-এর ঘটনায় আমরা লক্ষ্য করি যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-কে যখন একের পর এক সপ্ত আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, তখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিলো নবী-রাসূলগণের এবং আল্লাহর সান্নিধ্যের জন্য সপ্ত আসমানের উপর নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। এরপর যখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত নিয়ে মূসা (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন মূসা (আঃ) রাসূল (সাঃ) কে বলেছিলেন, তোমার উম্মত ৫০ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে সক্ষম হবে না। যাও আল্লাহর নিকট সালাত কমিয়ে নাও। এরপর কমাতে কমাতে পাঁচ ওয়াক্ত হয়। এরপর মূসা (আঃ) আরও কমাতে বলেছিলেন, কিন্তু রাসূল (সাঃ) লজ্জাবোধ করেছিলেন। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাতহা, ৫৮৬২) এসময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সালাত কমানোর জন্য সপ্ত আকাশের উপর উঠতেন। আবার ফিরে আসতেন মূসা (আঃ)- এর নিকট ষষ্ঠ আসমানে। এ দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে আছেন।
ফিরআউন নিজেকে রব দাবী করেছিলো। সে কাফির হওয়া সত্ত্বেও তার বিশ্বাস ছিলো যে, আল্লাহ আকাশের উপর আছেন।
আর ফিরআউন বললো, ”ওহে প্রধানগণ! তোমাদের জন্য আমি ছাড়া আর কোনো উপাস্য আছে বলে তো আমি জানি না! সুতরাং, হে হামান, তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও, তারপর আমার জন্য একটি উঁচু দালান তৈরী কর, হয়ত আমি মূসার উপাস্যের সন্নিকটে উঠতে পারবো। তবে আমি অবশ্য তাকে মিথ্যাবাদীদের একজন বলেই জ্ঞান করি।” [সূরা ক্বাসাস (২৮): ৩৮]
রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন,
“তোমরা কি আমাকে আমিন (বিশ্বাসী) বলে স্বীকার কর না? আমি তো ঐ সত্ত্বার নিকট আমিন বলে পরিগণিত যিনি আসমানের উপর আছেন।” [বুখারী, ৪৩৫১, মুসলিম, ১০৬৪]
আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, “দয়াকারীগণ আর-রহমান থেকে দয়া প্রাপ্ত হন। যারা জমিনে আছে, তাদের প্রতি দয়া কর, তবেই যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়াকরবেন।” [তিরমিযী, ১৯২৪(হাসান)]
অন্যত্র রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
“আরশ পানির উপর আর আল্লাহ আরশের উপর। তৎসত্ত্বেও, তোমরা কি কর বা না কর, তিনি তা জ্ঞাত আছেন।” [আবুদাউদ (হাসান)]
“নিশ্চয়ই জান্নাতের একশটি স্তর আছে, যা আল্লাহ মুজাহিদীনের জন্য সংরক্ষন করেছেন এবং দুইটি স্তরের মধ্যে আসমান জমিন ব্যবধান। সুতরাং যখন তোমরা আল্লাহর নিকট জান্নাত প্রার্থনা করবে তখন ফিরদাউস প্রার্থনা করবে। কারণ তা সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম জান্নাত। আর তার উপরে হলো দয়াময়ের আরশ।” [বুখারী, ২৭৯০]
ইমাম আবু হানিফা (র) এর মত
মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন, “ইমাম আ‘যম আবু হানিফা (রাহ) তাঁর ওসীয়াত নামক পুস্তকে বলেছেন,
আমরা স্বীকার ও বিশ্বাস করি যে, মহান আল্লাহ আরশের উপর সমুন্নত, আরশের প্রতি তাঁর কোনোরূপ প্রয়োজন ব্যতিরেকে এবং আরশের উপরে স্থিরতার প্রয়োজন ব্যতিরেকে। তিনি আরশ ও অন্য সবকিছুর সংরক্ষক। তিনি যদি আরশের মুখাপেক্ষী হতেন, তাহলে বিশ্ব সৃষ্টি করতে ও পরিচালনা করতে পারতেন না, বরং তিনি মাখলুকের মতো পরমুখাপেক্ষী হয়ে যেতেন। আর যদি তাঁর আরশের উপরে উপবেশন করার বা স্থির হওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে, তবে আরশ সৃষ্টির পূর্বে তিনি কোথায় ছিলেন? কাজেই আল্লাহ এ সকল বিষয় থেকে পবিত্র ও অনেক অনেক ঊর্ধ্বে।”[৮]
আবু মুতি আলহাকাম ইবনে আব্দুল্লাহ আলবালাখি বলেন, “আমি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কেউ যদি বলেযে, ‘আমি জানি না আল্লাহ্ কোথায় -আসমানে, না পৃথিবীতে,’ তাহলে তার সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছেন,
যে বলে আমি জানি না আমার রব আসমানে না জমিনে সে কুফরি করলো। অনুরুপভাবে যে বলে যে, আল্লাহ্ উপরে অধিষ্ঠিত, কিন্তু আমি জানি না আরশ কোথায় অবস্থিত, আকাশে না পৃথিবীতে। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন রহমান আরশের উপরে উঠেছেন। আর আল্লাহকে ডাকতে হয় উর্ধ্বে, নিম্নে নয়। নিম্নে থাকা উলুহিয়াতের বা রুবুবিয়াতের কোন বিশেষত্ব নয়।”[৯]
বিশর ইবনে ওয়ালীদ কিন্দি ইমাম আবু হানিফার প্রখ্যাত ছাত্র ইমাম আবু আবু ইউসুফের (রহঃ) নিকট গমন করে বলেন,
আপনি তো আমাকে ইলমূল কালাম থেকে নিষেধ করেন। কিন্তু বিশর আল মারিসী, আলী আল আওহাল এবং অমুক ব্যক্তি কালাম নিয়ে আলোচনা করছে। আবু ইউসুফ বলেন, “তারা কী বলছে?” আমি বললাম তারা বলছে যে, “আল্লাহ সকল স্থানে বিরাজমান।” তখন আবু ইউসুফ বলেন, “তাদেরকে ধরে আমার কাছে নিয়ে আসো।” তখন তারা তাঁদের নিকট গমন করে। ইত্যবসরে বিশর আল মারিসী উক্ত স্থান পরিত্যাগ করেছিলেন। এ জন্য আলী আহোয়াল ও অন্য একজন বৃদ্ধকে ব্যক্তিকে ধরে আনা হয়। আবু ইউসুফ বৃদ্ধ ব্যক্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, “আপনার দেহে শাস্তি দেওয়ার মতো স্থান থাকলে আমি বেত্রাঘাতের নির্দেশ দিতাম।” তিনি উক্ত বৃদ্ধকে কারারুদ্ধ করার নির্দেশ দেন এবং আলী আহওয়ালকে বেত্রাঘাত করা হয় এবং রাস্তায় ঘুরানো হয়।[১০]
ইমাম মালিকের অভিমত
আল্লাহ্র আরশে অধিষ্ঠিত হওয়া প্রসঙ্গে ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন, “ইস্তাওয়া অর্থ বোধগম্য, এর প্রকৃতি অজ্ঞাত। এর উপর ঈমান পোষণ করা ওয়াজিব এবং এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা বিদআত।” [শারহু আকিদাতুত তাহাবিয়া, তাফসিরে খাযিন, আবু নুয়াইম হিলাইয়া, ৬/৩২৫; আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ-২৪৯, যাহাবী একে সহীহ বলেছেন]
ইমাম আহমাদের অভিমত
এ বিষয়ে ইমাম আহমাদের মূলনীতি ব্যখ্যা করে আবু বকর খাল্লাল আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ (রহঃ) বলেন,
তিনি (ইমাম আহমদ) বলতেন, মহান আল্লাহ আরশের উপর অধিষ্ঠিত। … অধিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ তিনি এর ঊর্ধ্বে। মহান আল্লাহ আরশ সৃষ্টির পূর্ব থেকেই সবকিছুর উর্ধ্বে। তিনি সকল কিছুর উর্ধ্বে এবং সকল কিছুর উপরে। এখানে আরশকে উল্লেখ করার কারণ আরশের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্য কোনো কিছুর মধ্যে নেই। তা হলো আরশ সবচেয়ে মর্যাদাময় সৃষ্টি এবং সব কিছুর উর্ধ্বে। মহান আল্লাহ নিজের প্রশংসা করে বলেছেন যে, তিনি আরশের উপর অধিষ্ঠিত, অর্থাৎ তিনি আরশের উর্ধ্বে। আরশের উপরে অধিষ্ঠানের অর্থ আরশ স্পর্শ করে অবস্থান করা নয়। মহান আল্লাহ এরূপ ধারণার অনেক উর্ধ্বে। আরশ সৃষ্টির পূর্বে এবং আরশ সৃষ্টির পরে মহান আল্লাহ একই অবস্থায় রয়েছেন; কোনোরূপ পরিবর্তন তাঁকে স্পর্শ করেনি, কোনো গণ্ডি বা সীমা তাঁকে সীমায়িত করতে পারে না। যারা বলেন যে, মহান আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান , তাঁদের কথা তিনি অস্বীকার ও প্রতিবাদ করতেন। কারণ সকল স্থানই গণ্ডি বা সীমায় আবদ্ধ। তিনি আব্দুর রাহমান ইবন মাহদী থেকে, তিনি ইমাম মালিক থেকে উদ্ধৃত করতেন: মহান আল্লাহ মহা-পবিত্র আরশের উর্ধ্বে সমাসীন এবং তাঁর জ্ঞান-ইলম সর্বত্র বিদ্যমান।কোনো স্থানই তাঁর জ্ঞানের আওতার বাইরে নয়। আল্লাহর সর্বত্র বিরাজমান কথাটি ইমাম আহমদ ঘৃণ্য বলে গণ্য করতেন।
আরশ সৃষ্টির পুর্বে কোথায় ছিলেন?
ওয়াকি বিন হুদুস (রাঃ) বর্ননা করেন আমার চাচা আবু রাজিন বলেছেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! সৃষ্টি করার পূর্বে আমাদের রব কোথায় ছিলেন?” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তিনি ছিলেন মেঘের উপর, যার নিচে কিছু ছিলো না এবং উপরে কিছু ছিলো না। অত:পর তিনি পানির উপর আরশ সৃষ্টি করলেন।” [ইবনে মাজাহ, ১৮৭ (হাসান)]
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান মর্মে কুরআনুল কারীমের যেসব আয়াত উল্লেখ করা হয়, তার ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
আয়াত-১
“তিনিই আল্লাহ নভোমণ্ডলে এবং ভূমণ্ডলে। তিনি তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় জানেন এবং তোমরা যা কর তাও অবগত।” [সূরা আন’আম (৬):৩]
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, এই আয়াতের তাফসিরকারগণ সর্বপ্রথম জাহমিয়া সম্প্রদায়ের কথার উপর অস্বীকৃতির উপর একমত হয়েছেন। অতঃপর তাদের নিজেদের মধ্য কিছুটা মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। জাহমিয়াদের উক্তি এই যে, এই আয়াত এই অর্থ বহন করে যে আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক জায়গাতেই স্বয়ং বিদ্যমান রয়েছে। অর্থাৎ এই আকিদায় এই কথা গ্রহণ করা হচ্ছে যে, আল্লাহ পাক প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে স্বয়ং বিদ্যমান আছে। সঠিক উক্তি এই যে, আসমান ও জমিনে একমাত্র আল্লাহকেই মান্য করা হয় এবং তাঁরই ইবাদাত করা হয়। আকাশে যত ফেরেশতা আছে আর জমিনে যত মানুষ রয়েছে, সবাই তাঁকে মাবুদ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেছেন তিনি আসমানেরও আল্লাহ, জমিনেরও আল্লাহ।
আয়াত-২
“তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা দেখেন।” [সূরা হাদীদ (৫৭):৪]
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা হলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা আমাদের সাথে আছেন দেখার দ্বারা, শ্রবনের দ্বারা, যা বর্ণিত আছে তাফসিরে জালালাইন ও ইবনে কাসিরে। এই আয়াতের পূর্বের ও শেষের অংশ এ কথারই ব্যখ্যা প্রদান করে। হাফেয ইবনু কাসির (রহঃ) বলেছেন, “অর্থাৎ তিনি তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক এবং তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের কার্যসমূহের সাক্ষী। তোমরা ভূভাগে বা সমুদ্রে, রাতে বা দিনে, বাড়িতে বা বিজন মরুভূমিতে যেখানেই অবস্থান কর না কেন, সবকিছুই সমানভাবে তাঁর জ্ঞান এবং তাঁর শ্রবণ ও দৃষ্টির মধ্যে আছে। তিনি তোমাদের কথা শোনেন, তোমাদের অবস্থান দেখেন এবং তোমাদের গোপন কথা ও পরামর্শ জানেন।’’[১১]
আয়াত-৩
“আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটতর।” [সূরা ক্বাফ ৫০:১৬]
এ আয়াতের তাফসিরে ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, “আমি তার ঘাড়ের শাহরগ অপেক্ষাও নিকটতর, অর্থাৎ তাঁর ফেরেশতাগণ। কেউ কেউ বলেন যে এর দ্বারা আল্লাহর ইলম বা অবগতিকে বোঝানো হয়েছে।”
তাফসিরে মাআরেফুল কুরআনে উল্লেখ আছে, “অধিকাংশ তাফসিরবিদের মতে এই আয়াতে জ্ঞানগত নৈকট্য বোঝানো হয়েছে। স্থানগত নৈকট্য উদ্দেশ্য নয়।”
আয়াত-৪
“তখন আমি তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখ না।” [সূরা ওয়াক্বিয়াহ (৫৬):৮৫]
এখানে নিকটবর্তিতাকে মৃত্যুকালীন সময়ের সাথে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। আর মানুষের মৃত্যুর সময় যারা তার নিকট উপস্থিত থাকেন, তাঁরা হলেন ফেরেশতা। তাঁরা সেখানে একই স্থানে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“অবশেষে যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন আমার প্রেরিত দূতগণ তার প্রাণ হরণ করে নেয় এবং তারা কোনো ত্রুটিকরেনা।” [সূরা আন’আম (৬):৬১]
এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে, যদি আয়াত দু’টিতে ফেরেশতাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ নিকটবর্তিতাকে নিজের দিকে কেন সম্পর্কিত করলেন? এর জবাবে বলা যায় যে, ফেরেশতাদের নিকটবর্তিতাকে আল্লাহ নিজের দিকে সম্পর্কিত করেছেন কারণ তাঁর নির্দেশেই তারা মানুষের নিকটবর্তী হয়েছে। আর তারা তাঁর সৈন্য ও দূত। যেমন আল্লাহ বলেন,
“যখন আমি উহা পাঠ করি, তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর।” [সূরা ক্বিয়ামাহ (৭৫):১৮]
এখানে আল্লাহ কুরআন পাঠকে নিজের দিকে সম্পর্কিত করেছেন অথচ আল্লাহর নির্দেশে জিব্রাইল তা নাবী (সাঃ) এর নিকট পাঠ করেছেন।[১২]
সিফাতগুলোর বাহ্যিক প্রকাশমান অর্থ নেওয়া যাবে না?
কোনো কোনো আলিম সিফাত সম্পর্কিত শব্দগুলোর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতে চান না। তাঁদের মতে এভাবে বলা যে ‘ইয়াদ’, ‘কদম’, ‘আইনুন’ কিংবা ‘ইসতাওয়া’ এগুলো এমন যেমন ‘আলীফ- লাম-মীম’। এগুলোর বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। একমাত্র আল্লাহই এই শব্দগুলোর সত্যিকার অর্থ জানেন। সুতরাং তা আমরা আল্লাহর উপর ন্যস্ত করি।কালাম শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের মতে আল্লাহর সিফাত সম্পর্কিত শব্দগুলোকে আলোচনা বা ব্যাখ্যা না করে আল্লাহর উপর ন্যস্ত করা।
এ মতে মুতাশাবিহাতের অর্থ এমন করা হয় যে সিফাত সম্পর্কিত বর্ণনাগুলোর আক্ষরিক অর্থ উদ্দেশ্য নয় এবং আক্ষরিকভাবে তার অর্থ করাও সমীচীন নয়। উদাহরণস্বরূপ কুরআনে উল্লেখিত সিফাত ‘ইয়াদ’ দ্বারা কী বুঝিয়েছেন তা জানিনা, আল্লাহই জানেন; ‘ইসতাওয়া’ দিয়ে কী বুঝিয়েছেন জানি না, আল্লাহই জানেন; ‘ফেরেশতারা আরশ বহন করে নিয়ে আসবেন’ দিয়ে কী উদ্দেশ্য জানি না, আল্লাহই জানেন ইত্যাদি। সুতরাং তিলাওয়াতের সময় এগুলোর অর্থানুসন্ধান না করে এভাবে বলা যে এগুলো দ্বারা মহান আল্লাহ যা উদ্দেশ্য করেছেন তা সত্য এবং আমরা তার প্রতি ঈমান রাখি।
এই মতের একটা যথার্থ উদাহরণ মুফতি তাকি উসমানী তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন যাতে তিনি ইস্তিওয়া সম্পর্কে তাফিযীদ করে বলেন, اسْتَوَىٰ আরবী শব্দ। এর অর্থ সোজা হওয়া, কায়েম হওয়া, আয়ত্তাধীন করা ইত্যাদি। কখোনো এই শব্দটি বসা কিংবা সমাসীন হওয়া অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা’আলা যেহেতু শরীর ও স্থান থেকে মুক্ত ও পবিত্র, তাই তাঁর ক্ষেত্রে শব্দটি দ্বারা এরূপ অর্থ গ্রহণ সঠিক নয় যে মানুষ যেভাবে কোনও আসনে সমাসীন হয় তেমনিভাবে (নাউজুবিল্লাহ) আল্লাহ তা’আলাও আরশে উপবিষ্ট ও সমাসীন হন। প্রকৃতপক্ষে ইস্তাওয়া আল্লাহর একটি গুণ। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কেরামের মতে এর প্রকৃত ধরন ও ধারণ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তাঁদের মতে এটা মুতাশাবিহাত, যার খোঁড়াখুঁড়িতে লিপ্ত হওয়া ঠিক নয়। সুরা আলে ইমরানের শুরুতে আল্লাহ তা’আলা এরূপ মুতাশাবিহাত বিষয়ের অনুসন্ধানে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন। সে হিসেবে এর কোন তর্জমা করাও সমীচীন মনে হয় না। কেননা এর যে কোনো তরজমাতেই বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ আছে। এ কারণেই আমরা এ স্থলে এর তরজমা করিনি। তাছাড়া এর উপর কর্মগত কোনও মাসালাও নির্ভরশীল নয়। এটুকু বিশ্বাস রাখাই জরুরী যে আল্লাহ নিজ শান অনুযায়ী ‘ইসতাওয়া’ গ্রহণ করেছেন, যার প্রকৃতি ও স্বরূপ উপলব্ধি করার মতো জ্ঞান বুদ্ধি মানুষের নেই।”
ইমাম নববী শরাহ মুসলিম (৩/১৯)-এ উল্লেখ করেন, সকল অথবা অধিকাংশ সালাফগণের মতে এগুলোর অর্থ আলোচনা করা উচিত নয়। বরং এটা বলা উচিত, আমরা সেগুলো এরূপে বিশ্বাস করি যেন তার অর্থ আল্লাহর শান ও মর্যাদা অনুযায়ী হয়, যা আমাদের মৌলিক বিশ্বাস ‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়’ এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং যেন তিনি মুক্ত ও পবিত্র কোনো অবয়ব থেকে, চলাচল থেকে, দিক থেকে এবং সমস্ত সৃষ্ট উপাদান থেকে। এটা মুতাকাল্লিমিনগণের একটা বিরাট অংশের মাযহাব এবং অনেক মুহাক্কিক পছন্দ করেছেন। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা।
সালাফে সালেহীনের দুই একটি বক্তব্যকে তাঁরা তাঁদের মতের পক্ষে প্রমাণ পেশ করেছেন। যেমন, ইমাম সুফিয়ান বিন ইউয়ানা (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তাঁর কিতাবে নিজেকে যা দ্বারা বর্ননা করেছেন, সেগুলোর নীরব তিলাওয়াতই হচ্ছে তার ব্যাখ্যা, কোনো স্বরুপ নেই, কোনো ব্যখ্যা নেই।[১৩] ইমাম আহমাদ বলেছেন, আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, সত্য বলে গ্রহণ করি, কোনো কীভাবে নেই এবং কোনো অর্থ নেই। এ সকল বক্তব্যের ব্যখ্যায় তাঁরা বলেন যে সালাফে সালেহিনের মতে মহান আল্লাহর সিফাতগুলোর অর্থ অজ্ঞাত।
কিন্তু আমরা যখন চার ইমামসহ অন্যান্য সালাফে সালেহীনের বক্তব্যগুলো পূর্ণভাবে পাঠ করি যা পুর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তখন আমরা নিশ্চিত হই যে তাঁরা এসকল বিশেষণের অর্থ জ্ঞাত তবে ব্যাখ্যা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করে ব্যখ্যা বা স্বরুপকে আল্লাহর উপর ন্যস্ত করেছেন। যেমন তাবেয়ী মুজাহিদ (রহঃ) বলেছেন, আরশের উপর ইস্তাওয়া করেছেন অর্থ আরশের উর্ধ্বে থেকেছেন। তিনি বলেননি যে এ বাক্যটির অর্থ অজ্ঞাত। ইস্তাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে ইমাম মালিক ও অন্যান্য ইমামগণ বলেননি যে আল্লাহর ক্ষেত্রে ইস্তাওয়া কথাটির অর্থ আমরা জানি না।
মূলত সিফাতগুলোর অর্থ না করলে অন্য ভাষার মানুষ কীভাবে বিশ্বাস করবে? মহান আল্লাহর আরশে সমুন্নত হওয়া, রাতের শেষ ভাগে অবতীর্ণ হওয়া, কিয়ামতের দিন বিচারের জন্য আসা ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর ঈমান কীভাবে আনা যাবে? সুতরাং অর্থ অজ্ঞাত বলা উচিত নয় বরং তার স্বরুপ ও ব্যাখ্যা অজ্ঞাত।
উপসংহার
মহান আল্লাহর সিফাত সম্পর্কিত আলোচনার সমাপ্তিতে এখানে একটা হাদীস এবং তার উপর ইমাম তিরমিজির ভাষ্য উল্লেখ করছি,
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
“আল্লাহ দান কবুল করেন এবং তা তাঁর ডান হাত দ্বারা গ্রহণ করেন।”
আবু ঈসা (তিরমিযী) বলেন,
এটি হাসান সহীহ হাদীস। …. এ হাদীস এবং এ ধরনের যে সকল হাদীসে আল্লাহর বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে, মহান মহাপবিত্র প্রতিপালকের প্রথম আসমানে অবতরণের কথা বর্ণিত হয়েছে সে সকল হাদীস বিষয়ে আলিমগণ বলেছেন যে, হাদীস দ্বারা এগুলো প্রমাণিত এবং এগুলো বিশ্বাস করতে হবে, তবে কোনো কল্পনা করা যাবে না এবং ‘কীভাবে’ বলা যাবে না। মালিক, সুফিয়ান ইবন উআইনা, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক থেকে এ সকল হাদীসের বিষয়ে বর্ণিত যে, তোমরা এগুলোকে ‘কীভাবে’ (স্বরূপ সন্ধান) ব্যতিরেকে চালিয়ে নাও। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমদের এটিই মত। কিন্তু জাহমীগণ এ সকল হাদীস অস্বীকার করেছে। তারা বলে, এগুলো তুলনা। মহান আল্লাহ কুরআনের অনেক স্থানে হাত, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি বিশেষণ উল্লেখ করেছেন। জাহমীগণ এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করে। আলিমগণ এগুলোর যে ব্যাখ্যা করেছেন (স্বরূপবিহীন বিশ্বাস করা) জাহমীদের ব্যাখ্যা তার বিপরীত। তারা বলে: আল্লাহ আদমকে তাঁর হাত দিয়ে সৃষ্টি করেন নি। তারা বলে: এখানে হাত অর্থ ক্ষমতা। ইসহাক ইবন ইবরাহীম (ইবন রাহওয়াইহি) বলেন: তুলনা তো তখনই হয় যখন কেউ বলে: হাতের মতো হাত, অথবা হাতের সাথে তুলনীয় হাত, শ্রবণের মতো শ্রবণ অথবা শ্রবণের তুলনীয় শ্রবণ। কাজেই যদি কেউ বলে শ্রবণের মতো শ্রবণ বা শ্রবণের সাথে তুলনীয় শ্রবণ, তবে তা ‘তুলনা’। আর যখন কেউ আল্লাহ যেভাবে বলেছেন সেভাবে বলে: হাত, শ্রবণ, দর্শন, কিন্তু ‘কীভাবে’ বলে না এবং ‘শ্রবণের মতো’ বা ‘শ্রবণের সাথে তুলনীয়’ও বলে না, তখন তা তুলনা নয়। আল্লাহ কুরআনে এভাবেই বলেছেন: “কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয় এবং তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।”
গ্রন্থসূত্র ও তথ্যাবলী
[১] ফাতহ আল বারী, ৮/৬৪১
[২] বায়হাকী, আসমা ওয়াস সিফা্ত, ২/১৮৪
[৩] আল-ইতিকাদ, পৃ-১৭০; আল-উলু, পৃ-১৫৩
[৪] আল-ফিকহুল আকবার মুহাম্মাদ খামীসের শারহ সহ, পৃ-২১-৩৭, ইমাম আবু হানিফা
[৫] সিয়ারু আলামিন নুবালা-১০ম খণ্ড, পৃ-৮০; ইবনু কুদামা, জাম্বুত তাবিল পৃ-২৩
[৬] সিয়ারু আলামিন নুবালা ১১/২৪৬-২৪৮
[৭] তাফসীরে ইবনুল জাওযি
[৮] শারহুল ফিকহিল আকবার ,পৃ-৭০, মোল্লা আলী ক্বারী
[৯] শারহুল আকিদাহ আততাহাবিয়াহ, পৃ-১৮৬, ইবনে আবিল ইজ আলহানাফি; শারহুল ফিকহিল আকবার পৃ-১৭, সামারকান্দি
[১০] যাহাবী, আল উলুওউ লিল গাফফার, পৃ-১৫১
[১১] তাফসির ইবনে কাসির, ৭মখণ্ড, পৃঃ৫৬০
[১২] আল-কাওয়াইদুল মুছলা ফী ছিফাতিল্লাহি ওয়া আসমায়িহিল হুসনা, পৃঃ৭০-৭১
[১৩] বায়হাকি, আল আসমা ওয়াস সিফাত, ২/১৫৮
——————————————
“আল্লাহর চেহারা আছে”
“আল্লাহর চেহারা আছে” যা “জালাল ও ইকরাম” অর্থাৎ মহিয়ান এবং গরিয়ান গুণ বিশিষ্ট।
“এবং কেবলমাত্র তোমার রবের মহিয়ান ও গরিয়ান চেহারাই অবশিষ্ট থাকবে।”
***সুরাহ আর-রহমানঃ আয়াত-২৭।
“আল্লাহর মুখ আছে”
আল্লাহর মুখ আছে এবং তিনি কথা বলেন। যেমনঃ
“আল্লাহ মূসার সাথে কথা বলেছেন, যেভাবে কথা বলা হয়ে থাকে।”
***সুরাহ নিসাঃ আয়াত-১৬৪।
“যখন মূসা আমার নির্দিষ্ট সময়ে এসে পৌছলো এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন”।
***সুরাহ আ‘রাফঃ আয়াত-১৪৩।
আল্লাহ আরও বলেছেনঃ
“সমুদ্রগুলো যদি আমার রবের কথাসমূহ লেখার জন্য কালি হয়ে যেতো তাহলে আমার রবের কথা শেষ হওয়ার আগেই কালি শেষ হয়ে যেতো।”
***সুরাহ কাহ্ফঃ আয়াত-১০৯।
“আল্লাহর চক্ষু আছে”
মহান আল্লাহর দুটি হাক্বীক্বি(প্রকৃত) চক্ষু আছে। আল্লাহর সেই হাক্বীক্বি চক্ষু কেমন তা কেউ বলতে পারবে না।
“আমরা তা‘আলাকে দুনিয়ার কোন চোখ প্রত্যক্ষ করতে পারে না বরং তিনিই সমস্ত চোখকে প্রত্যক্ষ করতে পারেন। তিনি অতিশয় সুক্ষ্নদর্শী এবং সর্ববিষয়ে ওয়াকিফহাল।”
***সুরাহ আল-আন‘আমঃ আয়াত-১০৩।
সুতরাং কুরআন থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার হাক্বীক্বি/প্রকৃতই চোখ আছে। আর এটাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করা যাবে না।
আল্লাহ নূহ (আঃ)- কে বলেছিলেনঃ
نَعِ الْفُلْكَ بِأَعْيُنِنَا وَوَحْيِنَا وَلاَ تُخَاطِبْنِي فِي الَّذِينَ ظَلَمُواْ إِنَّهُم مُّغْرَقُونَ(37
আর আপনি আমার সম্মুখে বা আমার চোখের সামনে আমারই অহী বা নির্দেশ মোতাবেক একটি নৌকা তৈরী করুন এবং যালিম/ পাপিষ্ঠদের ব্যাপারে আমাকে কোন কথা বলবেন না। অবশ্যই তারা ডুবে মরবে।
***সুরাহ হূদঃ আয়াত-৩৭।
আল্লাহ মুসা(আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ
“যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও।”
***সুরাহ আত্ব-ত্বোয়াহাঃ আয়াত-৩৯।
আল্লাহ মহানবী(সাঃ)-কে বলেছিলেনঃ
وَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ حِينَ تَقُومُ
আপনি আপনার পালনকর্তার নির্দেশের অপেক্ষায় সবর করুন। আপনি আমার দৃষ্টির বা চোখের সামনে আছেন এবং আপনি আপনার পালনকতার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করুন যখন আপনি গাত্রোত্থান বা শয্যা ত্যাগ করেন।
***সুরাহ আত্ব-তুরঃ আয়াত-৪৮।
আল্লাহর চোখ আছে। এই বিষয়ে রাসুল(সাঃ) বলেছেনঃ
রাসুল(সাঃ) দাজ্জালের কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেনঃ
তোমাদের প্রভূ কানা নন, আর দাজ্জাল কানা হবে। দাজ্জালের ডান চোখ কানা হবে; তার চোখটি যেন ভেসে উঠা আংগুর।
***বুখারী, মুসলিমঃ ৪৪৪।
হাদিসে ‘তোমাদের প্রভূ কানা নন’ মানেই হল তার চোখ আছে। অবশ্য তা কেমন তা কেউ বলতে পারেনা বা পারবে না।
***আলবানী।
“আল্লাহর হাত আছে”
আল্লাহর হাত আছে। তবে, আল্লাহর সেই হাত কেমন তা কেউ বলতে পারবে না।
রাসুল(সাঃ) নিজ থেকে বানিয়ে মনগড়া কোন কথা বলেন নাই। তিনি জীবদ্দশায় যা কিছু বলেছেন সবই ওহীর মাধ্যমে।
তাই আল্লাহ স্বয়ং সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেনঃ
وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ
“সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত,
لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ
তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম,
ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ
অতঃপর কেটে দিতাম তার গ্রীবা/কণ্ঠনালী”।
***সুরাহ আল-হাক্বক্বাহঃ আয়াতঃ ৪৪-৪৬।
এই আয়াতগুলোর তাৎপয্য এই যে, যারা মনে করেন, আল্লাহর হাত নাই- তারা আসলে গোমরাহ। কারন, আল্লাহ বলেছেনঃ
“আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম।”
তবে, আল্লাহর সেই কুদরতী হাত কেমন তা কেউ বলতে পারবে না।
আল্লাহর উদার এবং উম্মুক্ত দুটি হাত রয়েছে।
“আল্লাহর হাততো উদার ও উন্মুক্ত। তিনি যেভাবেই ইচ্ছা খরচ করেন।”
***সুরাহ আল-মায়েদাহঃ আয়াত-৬৪।“
এসব লোকেরা তো আল্লাহর কদর যতটুকু করা উচিৎ তা করলো না, অথচ কেয়ামতের দিন গোটা যমীন তাঁর মুষ্ঠির মধ্যে থাকবে। আসমানসমূহ থাকবে তার ডান হাতের মধ্যে পেচানো অবস্থায়। এসব লোকেরা যে শিরক করে তা হতে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র।”
***সুরাহ আল-যুমারঃ আয়াত-৬৭।
“আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর।”
***সুরাহ আল-ফাতহঃ আয়াত-১০।
“আল্লাহর পা আছে”
আল্লাহর পা আছে। কিন্তু তার সেই কুদরতী পা কেমন তা কেউই বলতে পারবে না। বেনামাযী, কাফের, মুশরীক কেউই সেদিন আল্লাহ’কে সিজদা করতে সক্ষম হবে না। তারাই সৌভাগ্যবান যারা সেদিন আল্লাহ’কে সিজদা করতে সক্ষম হবে। আল্লাহ কুরআনের সুরাহ আল-কলমে ঘোষনা করেছেনঃ
يَوْمَ يُكْشَفُ عَن سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ
গোছা পর্যন্ত পা খোলার দিনের কথা স্মরণ কর, সেদিন তাদেরকে সিজদা করতে আহবান জানানো হবে, অতঃপর তারা সক্ষম হবে না।
***সুরাহ আল-কলমঃ আয়াত-৪২।
“আল্লাহর চেহারা আছে” যা “জালাল ও ইকরাম” অর্থাৎ মহিয়ান এবং গরিয়ান গুণ বিশিষ্ট।
“এবং কেবলমাত্র তোমার রবের মহিয়ান ও গরিয়ান চেহারাই অবশিষ্ট থাকবে।”
***সুরাহ আর-রহমানঃ আয়াত-২৭।
“আল্লাহর মুখ আছে”
আল্লাহর মুখ আছে এবং তিনি কথা বলেন। যেমনঃ
“আল্লাহ মূসার সাথে কথা বলেছেন, যেভাবে কথা বলা হয়ে থাকে।”
***সুরাহ নিসাঃ আয়াত-১৬৪।
“যখন মূসা আমার নির্দিষ্ট সময়ে এসে পৌছলো এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন”।
***সুরাহ আ‘রাফঃ আয়াত-১৪৩।
আল্লাহ আরও বলেছেনঃ
“সমুদ্রগুলো যদি আমার রবের কথাসমূহ লেখার জন্য কালি হয়ে যেতো তাহলে আমার রবের কথা শেষ হওয়ার আগেই কালি শেষ হয়ে যেতো।”
***সুরাহ কাহ্ফঃ আয়াত-১০৯।
“আল্লাহর চক্ষু আছে”
মহান আল্লাহর দুটি হাক্বীক্বি(প্রকৃত) চক্ষু আছে। আল্লাহর সেই হাক্বীক্বি চক্ষু কেমন তা কেউ বলতে পারবে না।
“আমরা তা‘আলাকে দুনিয়ার কোন চোখ প্রত্যক্ষ করতে পারে না বরং তিনিই সমস্ত চোখকে প্রত্যক্ষ করতে পারেন। তিনি অতিশয় সুক্ষ্নদর্শী এবং সর্ববিষয়ে ওয়াকিফহাল।”
***সুরাহ আল-আন‘আমঃ আয়াত-১০৩।
সুতরাং কুরআন থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার হাক্বীক্বি/প্রকৃতই চোখ আছে। আর এটাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করা যাবে না।
আল্লাহ নূহ (আঃ)- কে বলেছিলেনঃ
نَعِ الْفُلْكَ بِأَعْيُنِنَا وَوَحْيِنَا وَلاَ تُخَاطِبْنِي فِي الَّذِينَ ظَلَمُواْ إِنَّهُم مُّغْرَقُونَ(37
আর আপনি আমার সম্মুখে বা আমার চোখের সামনে আমারই অহী বা নির্দেশ মোতাবেক একটি নৌকা তৈরী করুন এবং যালিম/ পাপিষ্ঠদের ব্যাপারে আমাকে কোন কথা বলবেন না। অবশ্যই তারা ডুবে মরবে।
***সুরাহ হূদঃ আয়াত-৩৭।
আল্লাহ মুসা(আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ
“যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও।”
***সুরাহ আত্ব-ত্বোয়াহাঃ আয়াত-৩৯।
আল্লাহ মহানবী(সাঃ)-কে বলেছিলেনঃ
وَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ حِينَ تَقُومُ
আপনি আপনার পালনকর্তার নির্দেশের অপেক্ষায় সবর করুন। আপনি আমার দৃষ্টির বা চোখের সামনে আছেন এবং আপনি আপনার পালনকতার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করুন যখন আপনি গাত্রোত্থান বা শয্যা ত্যাগ করেন।
***সুরাহ আত্ব-তুরঃ আয়াত-৪৮।
আল্লাহর চোখ আছে। এই বিষয়ে রাসুল(সাঃ) বলেছেনঃ
রাসুল(সাঃ) দাজ্জালের কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেনঃ
তোমাদের প্রভূ কানা নন, আর দাজ্জাল কানা হবে। দাজ্জালের ডান চোখ কানা হবে; তার চোখটি যেন ভেসে উঠা আংগুর।
***বুখারী, মুসলিমঃ ৪৪৪।
হাদিসে ‘তোমাদের প্রভূ কানা নন’ মানেই হল তার চোখ আছে। অবশ্য তা কেমন তা কেউ বলতে পারেনা বা পারবে না।
***আলবানী।
“আল্লাহর হাত আছে”
আল্লাহর হাত আছে। তবে, আল্লাহর সেই হাত কেমন তা কেউ বলতে পারবে না।
রাসুল(সাঃ) নিজ থেকে বানিয়ে মনগড়া কোন কথা বলেন নাই। তিনি জীবদ্দশায় যা কিছু বলেছেন সবই ওহীর মাধ্যমে।
তাই আল্লাহ স্বয়ং সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেনঃ
وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ
“সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত,
لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ
তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম,
ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ
অতঃপর কেটে দিতাম তার গ্রীবা/কণ্ঠনালী”।
***সুরাহ আল-হাক্বক্বাহঃ আয়াতঃ ৪৪-৪৬।
এই আয়াতগুলোর তাৎপয্য এই যে, যারা মনে করেন, আল্লাহর হাত নাই- তারা আসলে গোমরাহ। কারন, আল্লাহ বলেছেনঃ
“আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম।”
তবে, আল্লাহর সেই কুদরতী হাত কেমন তা কেউ বলতে পারবে না।
আল্লাহর উদার এবং উম্মুক্ত দুটি হাত রয়েছে।
“আল্লাহর হাততো উদার ও উন্মুক্ত। তিনি যেভাবেই ইচ্ছা খরচ করেন।”
***সুরাহ আল-মায়েদাহঃ আয়াত-৬৪।“
এসব লোকেরা তো আল্লাহর কদর যতটুকু করা উচিৎ তা করলো না, অথচ কেয়ামতের দিন গোটা যমীন তাঁর মুষ্ঠির মধ্যে থাকবে। আসমানসমূহ থাকবে তার ডান হাতের মধ্যে পেচানো অবস্থায়। এসব লোকেরা যে শিরক করে তা হতে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র।”
***সুরাহ আল-যুমারঃ আয়াত-৬৭।
“আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর।”
***সুরাহ আল-ফাতহঃ আয়াত-১০।
“আল্লাহর পা আছে”
আল্লাহর পা আছে। কিন্তু তার সেই কুদরতী পা কেমন তা কেউই বলতে পারবে না। বেনামাযী, কাফের, মুশরীক কেউই সেদিন আল্লাহ’কে সিজদা করতে সক্ষম হবে না। তারাই সৌভাগ্যবান যারা সেদিন আল্লাহ’কে সিজদা করতে সক্ষম হবে। আল্লাহ কুরআনের সুরাহ আল-কলমে ঘোষনা করেছেনঃ
يَوْمَ يُكْشَفُ عَن سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ
গোছা পর্যন্ত পা খোলার দিনের কথা স্মরণ কর, সেদিন তাদেরকে সিজদা করতে আহবান জানানো হবে, অতঃপর তারা সক্ষম হবে না।
***সুরাহ আল-কলমঃ আয়াত-৪২।