কুরআনের আলোকে মানুষ সৃষ্টির কারণ
পৃথিবীতে আজ শত কোটিরও বেশী মানুষের বাস। এই এতো মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে মারা যাচ্ছে। তার কি কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই দুনিয়ায় জন্মাচ্ছে আর মৃত্যুবরণ করছে?
এর উত্তর অবশ্যই “না”। অর্থাৎ কোনো কারণ বা লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছাড়া পৃথিবীতে মানুষের জন্ম বা মৃত্যু হচ্ছে না। নিশ্চয়ই এর কোনো না কোনো কারণ রয়েছে। কেননা পৃথিবীর মালিক আল্লাহ, তিনি কিছুই অহেতুক সৃষ্টি করেন না।
আল্লাহ বলেন,
“আকাশ পৃথিবী এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে, তা আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। [ সুরা আম্বিয়া ২১:১৬ ] “
অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা হয়েছে বলেই তিনি এসব সৃষ্টি করেননি। এইসব সৃষ্টির পেছনে রয়েছে কোনো না কোনো কারণ লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।
অন্য আয়াতে বলেন,
“তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না? [সুরা মু’মিনুন ২৩:১১৫ ]”
সুতরাং মানুষকে আল্লাহ অনর্থক সৃষ্টি করেননি। সবকিছুর মতো মানুষকেও আল্লাহ কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করছেন। আসুন আমরা কুরআনের আলোকে মানুষ সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
মানুষ আল্লাহ্র প্রতিনিধি
আমরা যদি মানুষ সৃষ্টির শুরুর দিকে আলোকপাত করি, যখন মানুষ সৃষ্টি নিয়ে আল্লাহর সাথে মালাইকাদের সাথে কথা হয়। তখন আল্লাহ বলেন,
“আমি পৃথিবীতে একজন (আমার) প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি।” [ সুরা বাকারা ২:৩০ ]
অর্থাৎ আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এখন প্রতিনিধির কাজ হলো আল্লাহর নির্ধারিত নির্দেশিত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যে কাজ করা।
যেমন প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসি এবং রাষ্ট্রদূত রয়েছে। যাদের কাজ হলো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঐ দেশে কাজ করা। বাংলাদেশ সরকারের যাবতীয় কাজ অ্যাম্বাসির মাধ্যমে ঐ রাষ্ট্রদূত পরিপূর্ণভাবে পালন করেন। যার কাজ হলো দেশের স্বার্থ রক্ষা করা।
ঠিক তেমনি মানুষও আল্লাহর কাজ সমূহ পৃথিবীতে করার জন্য প্রতিনিধিত্ব করছে। আল্লাহর কাজ সমূহ কী? আল্লাহর কাজ সমূহ হলো যা আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে করতে আদেশ নিষেধ এবং নির্দেশ দিয়েছেন।
পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ হাজার হাজার নবী রাসুল পাঠিয়েছেন তাঁর বাণীসমূহকে প্রচার করার জন্য। সেই ধারাবাহিকতায় পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে তিনি মানুষকে শান্তির বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। পৃথিবীতে মানুষকে শান্তি বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই তার আদেশ নিষেধ গুলো মেনে চলতে হবে।
কেননা মানুষ সৃষ্টির সময় শয়তান মানুষ সৃষ্টির বিরোধীতা করেছিল। আল্লাহকে শয়তান চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল যে, সে মানুষকে নানানভাবে বিভ্রন্ত করে পৃথিবীতে আল্লাহ বিরোধী কাজে জড়িত করবে। সেইসাথে তাদেরকে আল্লাহর কাছে লাঞ্চিত করে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। মানুষকে এমন অপদস্থ করবে যাতে সে আর আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে না পারে। যাতেকরে তার সাথে তার মানুষ সাথীদেরও জাহান্নামে নিয়ে যেতে পারে।
পবিত্র কুরআনে বিষয়টি এভাবে এসেছে,
“সে (শয়তান) বললঃ হে আমার পালনকর্তা, আপনি আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেনঃ তোকে অবকাশ দেয়া হল।” [ সুরা সা’দ ৩৮:৭৯,৮০ ]
“সে (শয়তান) বলল, আপনার ইজ্জতের কসম, আমি অবশ্যই তাদের (মানুষদের) সবাইকে বিপথগামী করে দেব। তবে তাদের মধ্যে যারা আপনার খাঁটি বান্দা, তাদেরকে ছাড়া।” [সুরা সা’দ ৩৮:৮২, ৮৩ ]
“সে (শয়তান) বললঃ আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।” [সুরা আরাফ ৭: ১৬, ১৭]
উপরোক্ত আয়াত গুলো থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, শয়তান আমাদের পেছনে লেগে আছে সরল পথ থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে। সুতরাং শয়তানের চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে যে আদেশ নির্দেশ দিয়েছেন তা সবগুলোর সমন্বয় করাই হচ্ছে মানুষের খিলাফতের তথা প্রতিনিধিত্বের কাজ।
খিলাফতের কাজের মধ্যে প্রধানতম কাজ হলো তাওহীদ তথা একত্ববাদের প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই সেই সত্যকে অন্তরে ধারণ করা, প্রচার করা এবং প্রতিষ্ঠা করা।
আল্লাহ বলেন,
“তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নিধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। (অংশবিশেষ) [ সুরা শূরা ৪২:১৩ ]
অর্থাৎ পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি নবী রাসুলদের (আঃ) একটি কাজ দিয়েই আল্লাহ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। আর তা হলো আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করা, তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা এবং আল্লাহ “কে” তাঁর পরিচয় দেওয়া। সুতরাং মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহকে জেনে তাঁর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা করা।
আল্লাহ্র ইবাদতের জন্যে
দ্বিতীয়ত যে কাজের উদ্দেশ্যে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তা হলো তাঁর ইবাদত করার জন্য।
তিনি বলেন,
“আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। [ সুরা যারিয়া’ত ৫১:৫৬ ] “
অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর ইবাদত করবে এই উদ্দেশ্যেই তাকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। এখন আমাদের জানতে হবে ইবাদত শব্দের অর্থ এবং ব্যাখ্যা।
আমরা সাধারণত মনে করি সালাত সিয়াম হজ্ব যাকাত কুরবানী ইত্যাদিই হচ্ছে ইবাদত। যা পালন করলেই বুঝি আল্লাহর ইবাদত করা শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু বিষয়টি এতো অল্পতে শেষ হওয়ার নয়।
ইবাদত শব্দটি এসেছে আবদ্ শব্দ থেকে। আবদ্ অর্থ হলো দাস বা গোলাম। সোজা কথায় একান্ত অনুগত ভৃত্য। যার কাজই হলো তার মালিকের পরিপূর্ণ অনুগত হওয়া। অর্থাৎ মালিকের কোনো কথার খেলাপ না করা। করলেই শাস্তির মুখোমুখি হওয়া।
ঠিক সেই একইরকম ভাবে আমরাও আল্লাহর গোলাম বা দাস। যাদের কাজ হচ্ছে আল্লাহর গোলামী তথা তাঁর আদেশ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করা। এই আদেশ নির্দেশ কখনোই খন্ডকালীন নয়। এই আদেশ নির্দেশ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি সময়ের জন্য।
সুতরাং শুধু খন্ডকালীন সালাত বাৎসরিক সিয়াম, হজ্জ বা যাকাত কুরবানী দ্বারা পুরো জীবনের দাসত্ব বুঝায় না। ইবাদত তথা দাসত্ব হবে সর্বসময়ের জন্য। অর্থাৎ কুরআনের বর্ণিত প্রতিটি কথা আদেশ নির্দেশ পরিপূর্ণভাবে পালনের নামই হলো ইবাদত।
ঈমান আনার পর আল্লাহর পরিপূর্ণ আদেশ নির্দেশ মানার জন্য প্রতিটি মানুষকে আগে কুরআন জানতে হবে। কেননা কুরআন ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ নিষেধ ইত্যাদি পরিপূর্ণ জীবনবিধান জানা সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনই হলো আল্লাহর হিদায়াতের একমাত্র উৎস।
আল্লাহ বলেন,
“(হে রাসুলসাঃ) আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ (কুরআন) নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ।” [ সুরা নাহল ১৬:৮৯ ]
তিনি আরও বলেন,
“এ সেই কিতাব (পবিত্র কুরআন) যাতে কোনই সন্দেহ নেই। (যা) পথ প্রদর্শনকারী (প্রতিটি) পরহেযগারদের জন্য,” [ সুরা বাকারা ২:২ ]
সুতরাং কুরআন হচ্ছে হিদায়াতের অন্যতম মাধ্যম। যারা আল্লাহর সত্যিকারের বন্দেগী করতে চায় তাদের অবশ্যই কুরআনের জ্ঞান জানা অবশ্যক। কেননা কুরআনের জ্ঞান বিহীন কোনো মানুষই হিদায়াত তথা আল্লাহর সরল পথ প্রাপ্ত হতে পারে না।
আল্লাহ আরো বলেন,
“এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্যে মহা পুরস্কার রয়েছে।” [সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:৯ ] “
ওহীর জ্ঞানার্জনের জন্য
মানুষ সৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো তারা কুরআন জেনে এর থেকে হিদায়াত তথা আল্লাহর রহমত অন্বেষণ করবে। যদি মানুষ কুরআন না জানে তাহলে সে কখনোই সফলকাম হবেনা।
আল্লাহ বলেন,
“যে ব্যক্তি জানে যে, যা কিছু পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে তা সত্য, সে কি ঐ ব্যক্তির সমান, যে অন্ধ? তারাই বোঝে, যারা বোধশক্তি সম্পন্ন। [ সুরা রা’দ ১৩:১৯ ]
অন্য আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন,
“যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান।” [ সুরা যুমার ৩৯:৯ ]
অর্থাৎ মানব সৃষ্টির যে মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধিত্ব করা, সেটা করতে হলে অবশ্যই একজন মানুষকে কুরআনের জ্ঞান আহরণ করতে হবে। কেননা আল্লাহকে তাঁরাই বেশী ভয় করে যারা আল্লাহ সম্পর্কে বেশী জ্ঞান রাখে।
তাইআল্লাহ বলেন,
“আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে (আল্লাহকে) ভয় করে।” [সূরা ফাতির :২৮]
সুতরাং মানুষ সৃষ্টির আরেকটি কারণ হলো কুরআনের দ্বারা আল্লাহর জ্ঞানার্জন করা।
পরীক্ষা করার জন্য
তৃতীয়ত যে কারণে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তা হলো প্রতিটি মানুষকে পরীক্ষা করা।
আল্লাহ বলেন,
“তিনি (আল্লাহ) তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান যে, তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে ভাল কাজ করে।” [ সুরা হুদ ১১:৭ ]
অর্থাৎ আল্লাহ দুনিয়ায় মানুষ পাঠিয়েছেন কে কীরকম আমল করে, কতটুকু আমল করে ইত্যাদি জানার জন্য। পৃথিবীর রঙিন চাকচিক্যের মায়াজালে না জড়িয়ে, শয়তানের হাজারো ফাঁদকে উপেক্ষা, ক্ষুধা দারিদ্র্যের চরম কষ্ট ভোগান্তির মাঝেও, কে সঠিক ও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহকে ভালোবেসেছে এবং তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলেছে সেই কাজের পরিমাপ করার জন্যই পৃথিবীতে মানুষের আগমন।
অতএব আমরা যারা এখনো দুনিয়ার মায়াজালে জড়িয়ে আছি তারা যেন ভুলে না যাই আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপেরই পরীক্ষা চলছে। অতএব সেই হিসাবেই আমাদের চলা উচিত।
আমরা অনেকেই মনে করি মুসলমান যখন হয়েছি তাহলে আমরা অবশ্যই নাজাত পেয়ে যাবো। যেহেতু আমাদের ঈমান আছে। সেহেতু আমাদের আর পরীক্ষা করা হবেনা। সেইসাথে কোনো প্রকার দুঃখ কষ্টও ভোগ করতে হবেনা।
তাদের জন্য আল্লাহ বলেন,
“লোকেরা কি মনে করে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়া হবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?” (আল আনকাবুত ২৯:২)
সুতরাং ঈমান আনাটাই প্রধান বিষয় নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পরীক্ষা দেওয়া। আর এই পরীক্ষার অপর নাম হচ্ছে দুনিয়াবী কষ্ট ভোগ করা। শুধু সাধারণ মানুষ নয় আল্লাহ পরীক্ষা নিয়েছেন হাজারো নবী রাসুলদের। তাঁদের প্রতি আল্লাহর পরীক্ষা এমন ছিলো যে তাঁরা শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য কাকুতি মিনতী করে সাহায্য প্রার্থনা করেছে। সুতরাং প্রতিটি মানুষের জন্য আল্লাহর পরীক্ষা অনিবার্য।
কেননা আল্লাহ নিজেই বলেন,
“এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।” [ সুরা বাকারা ২:১৫৫ ]
প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ পরীক্ষা করবেন। পরীক্ষা ছাড়া কোনো বান্দাকেই আল্লাহ ছেড়ে দিবেন না। আর পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া কোনো মানুষই সফলতা লাভ করতে পারবে না। অতএব আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যই হলো পরীক্ষা করা।
মনুষ্যত্বের পরীক্ষা
চতুর্থতঃ মানুষ সৃষ্টির আরেকটি কারণ হলো মনুষত্বের পরীক্ষা নেওয়া। মানুষ হিসাবে জন্ম নিলেই সবাই সত্যিকারের মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে তার নিজস্ব সত্ত্বাগত কিছু গুণাবলীর প্রয়োজন। যা তাকে অর্জন করতে হয়।
পৃথিবীতে জীব বা প্রাণীর সাথে মানুষের পার্থক্য হচ্ছে বিবেক। মানুষের বিবেক আছে জীব পশুদের সেই বিবেক নেই। অর্থাৎ মানুষ যেমন খেয়ে দেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে সন্তান উৎপাদন করে। ঠিক একই কাজও পশুরাও করছে। খেয়ে দেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়া।
এখন যারা মানুষ তাদের আল্লাহ দিয়েছেন বিবেক যাতে করে তারা সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারে। যে বিবেক বা জ্ঞান পশুদের নেই সেই বিবেক এবং জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আমরা মানুষেরা পশু থেকে কতটুকু সত্যিকারের মানুষে রূপান্তরিত হতে পেরেছি সেটাই দেখতে চাইছেন আল্লাহ।
আল্লাহ বলেন,
“আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ।” [সুরা আরাফ ৭:১৭৯]
অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহ যে জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক দিয়েছেন তা দিয়ে সে নিজেকে কতটুকু পরিবর্তন করে আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে পেরেছে সেটাই দেখার বিষয়। যারা নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক দিয়ে সৃষ্টিকর্তার সন্ধান করতে পেরেছে তাঁরাই হচ্ছে সফল।
মানুষ যখন নিজের জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহর জ্ঞান অনুসন্ধান করে তখন সে বুঝতে পারে আল্লাহ কোনো কিছুই নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। যারাই এই জ্ঞানার্জন করতে পারে তাঁরাই হলেন মুমিন মুত্তাকী।
এই বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
“যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষযে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।” [ সুরা ইমরান ৩:১৯১ ]
সুতরাং আল্লাহ এবং তাঁর সৃষ্টিজগৎ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। মানুষ সৃষ্টির মূলে রয়েছে আল্লাহকে জানা এবং চেনা। আল্লাহকে চেনার জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন, সেই পাওয়া যাবে একমাত্র কুরআনের মাধ্যমে। যেখানে আল্লাহ প্রতিটি মানুষের জন্য হিদায়াতের পথ পন্থা বাতলে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেন,
“তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? [ সুরা মুহাম্মাদ ৪৭:২৪ ] “
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
“এমনিভাবে আমি সুস্পষ্ট আয়াত রূপে কোরআন নাযিল করেছি এবং আল্লাহ-ই যাকে ইচ্ছা হেদায়েত করেন।” [ সুরা হাজ্জ্ব ২২:১৬ ] “
সুতরাং মানুষ সৃষ্টির মূলে রয়েছে আল্লাহর জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়া। অর্থাৎ পবিত্র কুরআনের জ্ঞানার্জন করে আল্লাহকে সঠিকভাবে চেনা এবং জানা। সেইসাথে আল্লাহর আদেশ নির্দেশ সমূহ যথাযথভাবে পালন করা।
আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ
সর্বশেষ যে গুরুত্বপূর্ণ কারণে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তা হচ্ছে, দুনিয়ার জীবন শেষে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। অর্থাৎ একজন মানুষ দুনিয়ার জীবনে যা কিছু অর্জন করেছে তা নিয়ে সে মহান আল্লাহর সামনে কিয়ামতের ময়দানে দাঁড়াবে।
এইজন্যই তাকে দাঁড়াতে হবে যাতে সে তার জীবনের সকল কর্মকান্ডের ফিরিস্তি দিতে পারে। একমাত্র জ্বীন ও মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণী বা জীবের মৃত্যুর পর কোনো বিচার বা জবাবদিহিতা নেই। কিন্তু মানুষকে অবশ্যই তার জীবনের যাবতীয় কাজের জন্য কৈফিয়ৎ দিতে হবে।
শুধু তাই নয়, তার কর্মকাণ্ডের ভালো মন্দের বিচার বিশ্লেষণ শেষে আল্লাহ তাকে শাস্তি তথা জাহান্নাম অথবা শান্তি তথা জান্নাত প্রদান করবেন। এই জান্নাত এবং জাহান্নাম ভর্তি করার জন্যই আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ বলেন,
“নিশ্চয় জাহান্নাম প্রতীক্ষায় থাকবে, সীমালংঘনকারীদের আশ্রয়স্থলরূপে। [ সুরা নাবা ৭৮:২১, ২২ ] “
অর্থাৎ যারা আল্লাহর উপর ঈমান না এনে তাঁর আদেশ নির্দেশ অমান্য করেছে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি।
অন্য আয়াতে বলেন,
“পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তারাই জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে।” [ সুরা বাকারা ২:৮২ ] “
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা সবিশেষ এটাই জানতে পারলাম যে, আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টির মতো মানুষকেও সৃষ্টি করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে। আর এই দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব। যা প্রতিটি মানুষের উপর অত্যাবশ্যকীয় হিসাবে বর্তায়।
যারা আল্লাহর এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন জাহান্নামের আগুন। আর যারা এই দায়িত্ব পালনে সফল তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার তথা জান্নাত। যেখানে জান্নাতীরা থাকবে অনন্তকাল।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী (পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম)