পুরুষের জন্য লাল ও হলুদ রংয়ের পোশাক পরিধান করা কি সত্যিই হারাম? সঠিক তথ্য জেনে নিন

লাল হলুদ পোশাক ইসলাম
পুরুষের জন্য লাল ও হলুদ রংয়ের পোশাক পরিধান করা কি সত্যিই হারাম? সঠিক তথ্য জেনে নিন

ইসলামী শরীয়তের একটি মূলনীতি হল- যেকোন রঙের পোশাক পরাতে শারঈ কোন বাধা নেই,যদি তাতে কোন ধর্ম, জাতি এবং লিঙ্গের সাদৃশ্য না থাকে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা খাও, পরিধান কর এবং দান কর,কিন্তু কোন অপচয় ও অহংকার করোনা।’(সহীহ বুখারী হা/৫৭৮৩ তরমজাতুল বাব ‘লিবাস’ অধ্যায়-৭৭, অনুচ্ছেদ-১;সহীহ মুসলিম, হা/১০১৫; মিশকাত হা/৪২৮০; ২৭৬০)।

তবে বিভিন্ন কারণে ইসলামে কতিপয় পোশাক নিষিদ্ধ বা হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সেগুলো হ’ল-১. পুরুষের জন্য রেশমের পোশাক ও স্বর্ণ মিশ্রিত পোশাক। ২. পুরুষের জন্য মহিলাদের পোশাক ৩. মহিলাদের জন্য পুরুষদের পোশাক ৪. খ্যাতি ও বড়াই প্রকাশক পোশাক ৫. ভিন্ন ধর্মীয় পোশাক ৬. আঁটসাঁট পোশাক প্রভৃতি।

আলী ইবনু আবু তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ডান হাতে রেশম ও বাম হাতে স্বর্ণ নিয়ে বললেন, إِنَّ هَذَيْنِ حَرَامٌ عَلَى ذُكُورِ أُمَّتِيْ ‘এ দু’টি জিনিস আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম।’(আবূ দাঊদ, হা/৪০৫৭, ৪০৪০-৪০৫৩; নাসাঈ, হা/৫১৪৪; ইবনু মাজাহ, হা/৩৫৯৫, সনদ সহীহ)।উক্ত হাদীসের আলোকে চার মাযহাবের প্রসিদ্ধ ওলামাদের সম্মতিক্রমেও এটা হারাম। (ফাৎহুল ক্বাদীর, ১০ম খণ্ড, পৃ. ১৭; মাওয়াহিবুল জালীল, ২/১৮৯; আল-মাজমূউ ৪/৪৩৫; আল-মুগনী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪২১)

ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, রেশমের বস্ত্র পুরুষের উপর হারাম এবং মহিলাদের জন্য বৈধ, এটাই আমাদের মতামত এবং জমহুর আলেমের মতামত। (শারহুন নববী আলা মুসলিম, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ৩২)

ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত ও উলামার ইজমা দ্বারা প্রমাণিত যে,রেশমের বস্ত্র পরিধান করা পুরুষের জন্য হারাম।(মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২৯তম খণ্ড, পৃ. ২৯৮)। তবে কাপড়ে তালি দেয়ার উদ্দেশ্যে পুরুষের জন্য স্বল্প পরিমাণ তথা দুই আঙ্গুল বা তিন আঙ্গুল বা চার আঙ্গুল পরিমাণ রেশম ব্যবহার করা জায়েয।(সহীহ মুসলিম, হা/২০৬৯; রওযাতুত ত্বালিবীন, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৬)।

এখন আসুন পুরুষের জন্য লাল ও হলুদ রংয়ের পোশাক পরিধান করার বিধান কি?

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   সমাজে প্রচলিত কিছু শিরক এর তালিকা জেনে নিই (পর্ব ৩)।

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, .رَأَى رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَىَّ ثَوْبَيْنِ مُعَصْفَرَيْنِ فَقَالَ إِنَّ هَذِهِ مِنْ ثِيَابِ الْكُفَّارِ فَلَا تَلْبِسْهَا. وَفِيْ رِوَايَةٍ قُلْتُ أَغْسِلُهُمَا؟ قَالَ بَلْ اَحْرِقْهَا ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)আমার পরনে কমলা বা কুসম্ব রংয়ের দু’খানা কাপড় দেখতে পেলেন, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ মূলতঃ এটা কাফিরদের পোশাক। কাজেই তা পরো না। অপর এক রিওয়ায়াতে আছে, আমি বললামঃ আমি কি তাকে ধৌত করে ফেলব? তিনি বললেনঃ বরং এ দু’টিকে পুড়িয়ে ফেলো।(সহীহ মুসলিম, হা/২০২৭; ইঃফাঃ৫২৬০ সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ২৩৯৫, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৬১৮৪, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৪/২১, নাসায়ী ৫৩১৬, মুসনাদে আহমাদ ৬৯৩১,মিশকাত, হা/৪৩২৭)।
উক্ত হাদীস এনে ইমাম মুসলিম (রহঃ) সহীহ মুসলিমে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে:باب النَّهْىِ عَنْ لُبْسِ الرَّجُلِ الثَّوْبَ الْمُعَصْفَرَ، ‏‏ অর্থ:পুরুষের জন্য আসফার ঘাস দ্বারা রঞ্জিত কাপড় পরিধান করা নিষিদ্ধ।(অধ্যায়ঃ ৩৮/ পোশাক ও সাজসজ্জা)
উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যাঃ ‘সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী (রহঃ)বলেন,আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) (مُعَصْفَرَيْنِ) অর্থাৎ কুসম্ব রং দ্বারা রঙিন দু’টি কাপড় পরিধান করেছিলেন। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এটা পরিধান করতে নিষেধ করেন এবং তা জ্বালিয়ে ফেলতে বলেন। এর কারণ হলো এগুলো মুশরিক হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের ধর্মীয় পোশাক। বৌদ্ধ-ভিক্ষু,বৈরাগী-সন্ন্যাসীরাও গেরুয়া কিংবা কুসম্ব রঙের বিশেষ এক জোড়া পোশাক পরিধান করে থাকে। বর্তমানেও তাদের এ রকম পোশাক পরিলক্ষিত হয়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্ভবত তাদের সাথে সাদৃশ্যশীল এই পোশাক দেখেই উক্ত সাহাবীকে তা পরিধান করতে নিষেধ করেছেন।এমনকি তার নমুনাও যেন বাকী না থাকে তাই তা জ্বালিয়ে ফেলতে বলেছেন।
সাহাবী উক্ত কাপড় ধৌত করে পরিধানের অনুমতি চাইলেও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি প্রদান করেননি। কেননা ধুয়ে ফেললে গন্ধ দূর হলেও রং দূর হয় না। অথবা ঐ কাপড় দু’খানা বিশেষ ডিজাইনে তৈরি ছিল যা কাফির মুশরিকদের ধর্মীয় প্রতীক বহন করছিল। তাই মুসলিমদের ঐ কাপড় পরিধান করা আদৌ সঙ্গত নয়। অতএব তিনি জ্বালিয়ে সমূলে ধ্বংস করার নির্দেশ প্রদান করেন।(মিরক্বাতুল মাফাতীহ; শারহুন নাবাবী ১৪শ খন্ড; হাঃ ২০৭৬/২৪)

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   সমাজে প্রচলিত কিছু জাল হাদিস বা হাদিসের নামে মিথ্যা জেনে নিই পর্ব ২

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,ইমরান ইবনু হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আমি অত্যধিক লাল বর্ণের গদির উপর আরোহণ করি না। আমি হলুদ রংয়ের কাপড় পরিধান করি না এবং রেশমযুক্ত জামাও পরিধান করি না। (আবূ দাঊদ, হা/৪০৪৮; মিশকাত, হা/৪৩৫৪, সনদ সহীহ)।
আবূ দাঊদের অন্য বর্ণনায় আছে, আলী (রাঃ) বলেছেন, আমাকে উরজুরয়ানী তথা অত্যধিক লাল বর্ণের গদি ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন।(আবূ দাঊদ, হা/৪০৫০; মিশকাত, হা/৪৩৫৬, সনদ সহীহ)।
অন্য আরেক বর্ণনায় এসেছে, হেলাল ইবনু ‘আমের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে লাল বর্ণের চাঁদর পরিহিত অবস্থায় মিনায় একটি খচ্চরের উপর বসে খুৎবা প্রদান করতে দেখেছি।(আবূ দাঊদ, হা/৪০৭৩; মিশকাত, হা/৪৩৬৩, সনদ সহীহ)।
উপরোক্ত হাদীসের আলোকে লাল রঙের পোশাক পরিধান করা সম্পর্কে বিপরীতমুখী দু’রকম বর্ননা পাওয়া যায়।ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, يَجُوْزُ لُبْسُ الثَّوْبِ الْأَبْيَضِ وَالْأَحْمَرِ وَالْأَصْفَرِ وَالْأَخْضَرِ وَالْمُخَطَّطِ وَغَيْرِهَا مِنْ أَلْوَانِ الثِّيَابِ وَلَا خِلَافَ فيْ هذا، ولا كراهة في شيء مِنْهُ. قَالَ الشَّافِعِيُّ وَالْأَصْحَابُ: وَأَفْضَلُهَا الْبِيضُ ‘পোশাক, লাল, সাদা, হলুদ, সবুজ যেকোন রঙ এবং সাধারণ কাপড় বা নকশাকৃত পোশাক পরিধান করা যায়। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোন মতনৈক্য বা কারাহাত নেই। ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এবং তাঁর অনুসারীর বক্তব্য: উত্তম হল, সাদা রঙের পোশাক পরিধান করা (মাজমূ‘আ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৫২)। জায়েয হলেও কেউ কেউ পূর্ণ লাল ও পূর্ণ হলুদ রঙের পোশাক পরাকে মাকরূহ বলেছেন.(ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৩৪৪২)

লালবর্ণের পোশাকের ব্যাপারে বর্ণিত বিপরীতমুখী হাদীসের মাঝে সমন্বয় সম্পর্কে শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিঃ) বলেন-লাল রংয়ের কাপড় তখন জায়েয, যখন লাল রংয়ের সাথে বিভিন্ন রং থাকবে। আর যদি শুধু এক কালারের লাল হয়ে থাকে তাহলে সে কাপড় পরা যাবে না।(শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ, ফাতাওউল ইসলাম সুওয়াল ও জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৮৩৪১)।তবে বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ থাকলেও তাক্বওয়ার পোশাক হিসাবে লাল রঙ এড়িয়ে চলাই উচিত।

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   ইমাম আবু হানিফা (রা.) কি সত্যিই এশার অজু দিয়ে ফজরের নামাজ পড়তেন ? ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত জেনে নিন।

পরিশেষে,উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে,এই উম্মতের পুরুষদের জন্য রেশমের পোশাক ও স্বর্ণ মিশ্রিত পোশাক পরিধান করা সরাসরি হারাম,এই বিষয়ে আহালুল ইমামগনের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই।আর লাল এবং কুসম্ব (গেরুয়া হলুদ) রংয়ের পোশাক পরিধানের সমন্বয় হল অবিমিশ্র উজ্জ্বল লাল রংয়ের কাপড় পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ।এটা নিয়ে জমহুর ওলামাগন একমত তবে হলুদ কাপড় পরা সম্পর্কে ওলামাদের মধ্যে মতানৈক্য আছে।কেননা হাদীসে যে শব্দটি এসেছে(الْمُعَصْفَرَ) এর অর্থ বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে অনেকে হলুদ করেছেন আবার অনেকে কুসম্ব বা রঙিন গেরুয়া রং করেছেন।এটাই মতপার্থক্য তবে বিশুদ্ধ মতে (اصْفَرَ) শব্দের অর্থ হলুদ। কিন্তু হাদীসে এসেছে (الْمُعَصْفَرَ) মুয়াসফার আইন দিয়ে শব্দের অর্থ কুসম্ব বা গেরুয়া জাফরান ইত্যাদি। যেটা মূলত বৌদ্ধ-ভিক্ষু, বৈরাগী-সন্ন্যাসীরাও গেরুয়া কিংবা কুসম্ব রঙের বিশেষ এক জোড়া পোশাক পরিধান করে থাকে। তাই যারা বলেছেন হলুদ পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ বা নাজায়েজ নয় এই মতটাই অধিকতর সঠিক। পাশাপাশি কাপড়ে লাল ও কুসম্ব বা গেরুয়া রং এর সাথে অন্য রং মিশ্রিত থাকলে উক্ত লাল এবং গেরুয়া পোষাক পরিধান করতেও কোন বাধা নেই ইনশাআল্লাহ। (নববী, আল-মাজমূ‘ ৪/৩৩৭ আল-মাওসূআতুল ফিক্বহিয়াহ ৬/১৩২-৩৬;ইবনে উসাইমিন,আশ-শরহুল মুমতে)

তবে মতানৈক্য এড়াতে মুত্তাকীদের উচিত বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ থাকলেও তাক্বওয়ার পোশাক হিসাবে লাল ও কুসম্ব বা গেরুয়া রঙ এড়িয়ে চলা।কেননা মুত্তাকীদের একটি গুণ হলো তারা সন্দেহপ্রবণ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলবে। উল্লেখ্য,রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাদা কাপড় পরিধানের কথা বলেছেন। কেননা তা পবিত্র ও অধিক পছন্দনীয়।(মুসনাদে আহমাদ, হা/২০১৬৬; তিরমিযী, হা/২৮১০; নাসাঈ, হা/১৮৯৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৫৬৭; মিশকাত, হা/৪৩৩৭, সনদ সহীহ)। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কালো রঙের পোশাকও পরিধান করতেন (আবূ দাঊদ, হা/৪০৭৪; মিশকাত, হা/৪৩৬৪, সনদ সহীহ)।

(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)

MuslimPoint Organization

About MuslimPoint Organization

MuslimPoint একটি অনলাইন ভিত্তিক ইসলামী প্রশ্নোত্তর, গ্রন্থাগার, ব্লগিং, কুরআন, হাদিস, কুইজ এবং বিষয় ভিত্তিক রেফারেন্স প্ল্যাটফর্ম।

View all posts by MuslimPoint Organization →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *