আয়া সোফিয়া মসজিদে রূপান্তর ও কিছু সাম্প্রতিক বিষয় ।

আয়া-সোফিয়া
প্রাককথন :

ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগ স্থানে অবস্থিত তুরস্কের শহর ইস্তাম্বুল। বলা হয়ে থাকে, ইস্তাম্বুল দুই মহাদেশে অবস্থিত। ইস্তাম্বুল শহরের ফাতিহ এলাকায় অবস্থিত বিশ্ব বিখ্যাত স্থাপনা আয়া সোফিয়া (Aya Sophia)  বা হাগিয়া সোফিয়া (Hagia Sophia) এক সময় ছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মীয় উপাসনালয়। পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিজয়ের ফলে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতকের ত্রিশের দশক পর্যন্ত এটি ছিল মুসলিমদের অন্যতম মসজিদ।

ইসলামী খেলাফত ধ্বংস করে দেয়ার পর তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৪ সালে এই মসজিদকে জাদুঘরে রূপান্তর করেন। গত ১০ জুলাই তুরস্কের প্রশাসনিক আদালত এটিকে জাদুঘর থেকে পুনরায় মসজিদ করার নির্দেশ দেয়। এর ফলে গত ১০ জুলাই আয়া সোফিয়ার সুউচ্চ মিনার থেকে আযানের ধ্বনিতে আশেপাশের আকাশ-বাতাস মুখরিত হতে থাকে। তুরস্কের মুসলিমরা জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে বিজয় উল্লাস করে, এক আবেগঘন পরিস্থিতির তৈরি করে।

কিন্তু গ্রীস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা কিছু দেশ আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তর করার নিন্দা করেছে। অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মীয়গুরু এবং ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মীয় গুরু পোপ তুরস্কের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমনকি ইউনেস্কো যারা আয়া সোফিয়াকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা করেছিল, তারাও এর প্রতিবাদ জানিয়েছে।

কনস্টান্টিনোপল থেকে ইস্তাম্বুল :

রাসূল (ছা.)-এর সময় থেকেই  অন্যতম পরাশক্তি ছিল রোমান বাইজানটাইন সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের রাজধানী মুসলিমদের পদাবনত হবে এটা রাসূল (ছা.) বলে গিয়েছিলেন। তাই ছাহাবায়ে  কেরাম (রা.)-এর পর ওছমানীয় সুলতানগণ চেষ্টা করেছেন এই নগরটি দখল করতে। অবশেষে ওছমানীয় খলীফা দ্বিতীয় মুহাম্মাদ ১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল কনস্টান্টিনোপল নগরী অবরোধ করেন এবং দীর্ঘ দিনের অবরোধের পর এটি দখল করতে সমর্থ হন। এই মহান বিজয়ের ফলে দ্বিতীয় মুহাম্মাদকে ‘ফাতিহ’ বা বিজয়ী উপাধি প্রদান করা হয়। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ক্রুসেডের তুলনায় এই বিজয় ছিল তুলনামূলক অনেক মানবিক।

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   পীর মুরীদি সম্পর্কে ইসলাম কি বলে ? জেনে নিন বিস্তারিত ।

সুলতান কনস্টান্টিনোপলের গুরুত্ব উপলব্ধি করে একে ওছমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করেন এবং নাম পরিবর্তন করে রাখেন ইস্তাম্বুল।

আয়া সোফিয়া গির্জা :

আয়া সোফিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান। তার নির্দেশে অর্থোডক্স খ্রিস্টান চার্চ হিসাবে ৫৩২ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ শুরু হয়। ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে তা শেষ হয়।

গ্রীক পুরাণ মতে, সোফিয়া হচ্ছেন জ্ঞানের দেবী। সেই হিসাবে আয়া সোফিয়া শব্দের অর্থ দাঁড়ায় যড়ষু holy wisdom বা পবিত্র জ্ঞান।

নির্মাণের পর থেকে এটি অর্থোডক্স গির্জা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় ক্রুসেড-এর সময় ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা একে দখল করে নেয় এবং ক্যাথলিক চার্চ হিসাবে পরিচালনা করে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ধর্মীয় কারণে খ্রিস্টানরা একসময় তাদের এই উপাসনালয় দখল করে নিজেদের উপাসনালয় হিসাবে জোর করে চালিয়েছে। আবার ১২৬১ খ্রিস্টাব্দে অর্থোডক্সরা ক্যাথলিকদের পরাজিত করে অর্থোডক্স চার্চে পরিণত করে। সে সময়ে এটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং বৃহত্তম অর্থোডক্স চার্চ। শুধু তাই নয়, সে সময় আয়া সোফিয়া রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল। এখানে রাজ্যাভিষেকসহ যাবতীয় অনুষ্ঠান হত, এমনকি রাজমুকুট এখানে সংরক্ষিত ছিল।

গির্জা থেকে মসজিদ হলো আয়া সোফিয়া :

ইস্তাম্বুল নাম করার পর সুলতান ফাতিহ, খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে আয়া সুফিয়া কিনে নিয়েছিলেন। মুসলিম বিজয়ের পর অর্থ অভাবেই হোক অথবা এত বড় চার্চের আর প্রয়োজন না থাকার কারণেই হোক খ্রিস্টান যাজকরা সে সময়ে এটা সুলতান ফাতিহর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেনম। আর তুরস্কের গণমাধ্যম সে বিক্রির ভাউচার প্রদর্শন করেছে। তুরস্কের গণমাধ্যমের পাশাপাশি আল-জাজিরা চ্যানেল এই ভাউচার প্রকাশ করেছে। এরকম বর্তমান আধুনিক ইউরোপের অনেক চার্চ অর্থের বিনিময়ে মুসলিমদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।

খ্রিস্টানদের কাছ থেকে ক্রয় করার পর ওছমানী সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ এতে চারটি মিনার সংযুক্ত করেন। পরবর্তীতে এই স্থাপনার সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য সুলতান দ্বিতীয় সেলিম স্থপতি মিমার সিনানকে নিযুক্ত করেন। শুধু সৌন্দর্যবর্ধনেই নয়, বরং মিমার সিনান প্রথম স্থপতি, যিনি ভূমিকম্প থেকে স্থাপনাকে রক্ষা করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আরও দু’টো মিনার আয়া সোফিয়া যুক্ত করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সুলতান বিভিন্নভাবে এতে অবদান রাখেন এবং একটি মাদরাসা স্থাপন করেন, যেটি বর্তমানে একটি গ্রন্থাগার হিসাবে এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে। মূলত ওছমানীয় স্থাপত্যে আয়া সোফিয়ার গুরুত্ব অত্যধিক। কারণ পরবর্তী সময়ে তারা যে মসজিদগুলো বানিয়েছিল, তা আরব স্থাপত্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল এবং তারা আয়া সোফিয়ার আদলে মসজিদ নির্মাণ করেছিল।

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   হামাস কি শিয়া নাকি সুন্নী ? এরা কি ফিলিস্তিনের সুন্নী মুসলমানদের বন্ধু নাকি শত্রু ? ব্যাখ্যা সহ বিস্তারিত ।
জাদুঘরে রূপান্তর :

বানরকে যে কোট-টাই পরিয়ে দিলেই সে আধুনিক হয়ে যাবে এমন ধারণা যেমন ভুল, তেমনি মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নয়ন ছাড়া মানুষের উন্নয়ন সম্ভব নয়- তা বুঝতে পারেনি সেই সময়ের নব্য সংস্কারবাদী তুরস্কের কিছু সেকুলার মানুষ। তারা উন্নয়ন আর ইসলাম দু’টোকে শত্রু হিসাবে দেখানো শুরু করেছিল। ফলশ্রুতিতে তারা খেলাফত ধ্বংস করে এবং মুসলিমদের ঐতিহ্যগুলো ম্লান করে দেওয়া শুরু করে। এরই অংশ হিসাবে কামাল আতাতুর্ক বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন নিষিদ্ধ করেন এবং অনেক মসজিদ বন্ধ করে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৪ সালে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন।

ছিয়াশি বছর পরে আযানের ধ্বনি :

তুরস্কের রাজনীতি যারা দেখে আসছেন, তারা ভালোভাবেই জানেন এরদোগান ঠিক কতটা চালাক এবং কৌশলী মানুষ। রাজনীতি তিনি খুব ভালোভাবে বোঝেন। মুস্তফা কামালপন্থী সেকুলাররা এখনো তার দেশে আছে, তারা রাজনীতিতে সক্রিয়, তাই তিনি অত্যন্ত কৌশলে তার মতের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। এরপর বিষয়টি আদালতে গড়ায়, আদালত থেকে আসার পর তিনি আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের বিলে স্বাক্ষর করেন। ফলে ৮৬ বছর পরে আবার তুরস্কের মানুষ আয়া সোফিয়ায় আযানের ধ্বনি শুনতে পান।

উল্লেখ্য, আয়া সোফিয়ার ভিতরে রোমান এবং ওছমানীয় খেলাফতের স্থাপত্যিক নিদর্শন বিদ্যমান। মসজিদ হওয়ার ফলে অন্য ধর্মাবলম্বীরা এখানে ঢোকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না। তুরস্কের সরকারের পক্ষ থেকে এমনটাই জানানো হয়েছে। আর আগামী ২৪ জুলাই থেকে ছালাতের জন্য আয়া সোফিয়া উন্মুক্ত করা হবে।

যবনিকা :

আয়া সোফিয়াকে নিয়ে আমাদের মুসলিমদের মধ্যে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ এই পদক্ষেপের মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করত সংশোধনের লক্ষ্যে গঠনমূলক সমালোচনাও সহ্য করছেন না। অপরপক্ষে কেউ এই প্রশংসনীয় পদক্ষেপের এত বেশি খুঁত খুঁজে বের করছেন যেন গীর্জাকে মসজিদে রূপান্তর করে কোনো অপরাধ করা হয়েছে। আমরা বলব, সকল ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে হক্বকে হক্ব বলা ও বাতিলকে বাতিল বলা উচিত। মুসলিমদের খলীফা মুহাম্মাদ আল-ফাতিহের ওয়াক্ফকৃত এই মসজিদ পুনরায় ছালাতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যেমন প্রশংসার যোগ্য পদক্ষেপ, ঠিক তেমনি মসজিদের মধ্যে মূর্তি রাখা বা আশে-পাশে মাযার রাখা অবশ্যই সমালোচনা যোগ্য। আমরা চাইব তুরস্কের সরকার আরেকটু সাহসিকতা দেখিয়ে আয়া সোফিয়া থেকে মূর্তি ও মাযার সরিয়ে পূর্ণাঙ্গ মসজিদে রূপান্তর করবেন। আল্লাহ তাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন! আপামর মুসলিম জনতার উচিত এই বিষয়ে অনর্থক ট্রল পরিহার করা। কেননা এগুলো শুধু শুধু সময় অপচয় মাত্র। মুসলিমদের প্রকৃত বিজয় আদর্শ ও নৈতিকতার বিজয়। যা তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। রাসূল (ছা.) বলেছেন, مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ ‘একজন মুসলিমের ইসলামের সৌন্দর্যতা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় বিষয় পরিহার করা’। [বুলূগুল মারাম, হা/১৪৮৯।, nv/1489]

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   প্যারানরমাল বা জ্বীন বিষয়ে ইসলাম কি বলে ?

সুতরাং অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অনর্থক তর্ক-বিতর্ক পরিহার করে প্রত্যেক মুসলিমের উচিত গঠনমূলক কাজে মনোযোগ দেওয়া। সর্বদা নিজেদের আদর্শ ও নীতি-নৈতকতার উন্নয়নের চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

collected : here 

-মুতাছিম বিল্লাহ*
* শিক্ষক (বাংলা), আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ,
বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।

MuslimPoint Organization

About MuslimPoint Organization

MuslimPoint একটি অনলাইন ভিত্তিক ইসলামী প্রশ্নোত্তর, গ্রন্থাগার, ব্লগিং, কুরআন, হাদিস, কুইজ এবং বিষয় ভিত্তিক রেফারেন্স প্ল্যাটফর্ম।

View all posts by MuslimPoint Organization →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *