জেনে নিই হজ্জ ও উমরা এর বিস্তারিত(পর্ব ৯)।

হজ্জ-হাজী-muslimpoint
পর্ব ৯ঃ

✅মক্কা ও মসজিদুল হারামের ইতিহাস
=========================

মক্কা সম্মানিত শহর। ‘বাইতুল আতিক’ পুরাতন ঘর অর্থাৎ ‘কা‘বা’র সম্মানের কারণে মক্কাকে সম্মানিত করা হয়েছে। সকল শহরের চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট প্রিয় এ শহর, মুসলিমদের কিবলা ও হজের স্থান।

✅এ পবিত্র শহরকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কয়েকটি নামে উল্লেখ করেছেন:
=======================
মক্কা ২) বাক্কা ৩) আল-বালাদ ৪) আল-কারিয়াহ ৫) উম্মুল কুরা

‘‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন একটি জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত’’।[1]

সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশের জন্য আল্লাহ তা‘আলা মক্কার কসম করে বলেছেন; ‘‘আমি এ নগরের শপথ করছি’’।[2]

মক্কায় বসবাস উত্তম, এখানে নেকী ও ইবাদত উত্তম; ঠিক তেমনি খারাপ কাজ এবং পাপের গুনাহও অনেক বেশি। মক্কাকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। মক্কায় মহামারী/প্লেগ রোগ ছড়াবে না কখনও, মক্কায় দজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না। মক্কা প্রবেশ এর সকল পথে আল্লাহর ফেরেশতারা রক্ষী হিসাবে অবস্থান করছেন।

আব্দুল্লাহ ইবন আদী ইবন আল-হামরা থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, ‘‘আল্লাহর কসম, হে মক্কা তুমি আল্লাহর সকল ভূমির চেয়ে উত্তম ও আমার নিকট অধিক প্রিয়। আমাকে যদি তোমা হতে বের হওয়ার জন্য বাধ্য না করা হত তাহলে আমি কখনো বের হতাম না’’।[3]

কা‘বা ঘর ও এর চারপাশে তাওয়াফের জায়গা বেষ্টন করে যে মসজিদ স্থাপিত তা মসজিদুল হারাম নামে পরিচিত। কা‘বা ঘরের চারপাশে তাওয়াফের জায়গার মেঝেকে মাতাফ বলা হয়। কা‘বা ঘরের তাওয়াফ শুরু করার কর্নারটি হাজরে আসওয়াদ কর্নার নামে পরিচিত। এর ডান পাশের কর্নারটি ইরাকি কর্নার, তার ডান পাশের কর্ণারটি শামি কর্নার এবং তার ডান পাশের কর্ণারটি ইয়েমেনী কর্নার নামে পরিচিত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মসজিদে হারাম ব্যতীত আমার এ মসজিদে (মসজিদে নববী) সালাত অন্য স্থানে সালাতের চেয়ে ১ হাজার গুণ উত্তম, আর মসজিদে হারামে সালাত ১ লক্ষ সালাতের চেয়ে উত্তম’’।[4]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় কা‘বা ও মসজিদুল হারামকে কেন্দ্র করে এর চারপাশে অনেক বসতি গড়ে উঠেছিল যা পরবর্তীতে ক্রমবর্ধমান মুসল্লীদের জন্য সালাতের জায়গার সংকুলান হচ্ছিল না।

খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে প্রথমে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও পরে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু মসজিদের আশেপাশের জায়গা লোকদের কাছ থেকে ক্রয় এর সীমা বর্ধিত করেন ও প্রাচীর দিয়ে দেন। পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়ের মসজিদের পূর্বদিকে এবং আবু জাফর মনসুর পশ্চিম দিকে ও শামের দিকে প্রশস্ত করেন। পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন মুসলিম শাসকদের আমলে মসজিদুল হারামের সীমা বর্ধিত হয় ও সংস্কার সাধিত হয়।

এরপর প্রায় এক হাজার বছর মসজিদের সীমা বর্ধিত করার কোনো কাজ করা হয় নেই। অতঃপর ১৩৭০ হিজরীতে সৌদি বাদশাহ আব্দুল আযীয ইবন আব্দুর রহমান আল সাউদ এর আমলে মসজিদের জায়গা ছয় গুণ বৃদ্ধি করে আয়তন হয় ১,৮০,৮৫০ মিটার। এ সময়ে মসজিদে মার্বেল পাথর, আধুনিক কারুকার্য, নতুন মিনার সংযোজন করা হয়। সাফা মারওয়া দোতলা করা হয়। ছোট বড় সব মিলিয়ে ৫১টি দরজা তৈরি করা হয় মসজিদে।

এরপর সৌদি বাদশা ফাহাদ ইবন আব্দুল আযীয প্রশস্তকরণের কাজে হাত দেন। তিনি মসজিদের দোতলা, তিন তলা ও ছাদে সালাতের ব্যাবস্থা করেন। তিনি মসজিদের আধুনিকায়নের জন্য অনেক কাজ করেন।

হারামের প্রশস্তকরনের কাজ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কাজ; কিন্তু মুসল্লিদের এক ইমামের পিছনে একত্রিত করাও ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আগে মসজিদে চার মাযহাবের লোকেদের চারটি আলাদা মুসল্লা গড়ে উঠেছিল। এক আযানের পর চার আলাদা জায়গায় চার মাযহাবের লোকদের চারটি আলাদা জামাআত হতো। যার ফলে মুসলিমদের মাঝে ভাঙ্গন ও অনেক বিদ‘আতি প্রথা প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু পরে আল সাউদ এর আমলে সকল মুসলিমকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সালাফে সালেহীনদের পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন ও সকল মুসলিমদের এক ইমামের পিছনে সালাত আদায়ের আদেশ দেন।

সর্বশেষ ২০১০ খৃঃ সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহর তত্ত্বাবধানে মসজিদুল হারামের তাওয়াফ ও মূল মসজিদ প্রশস্তকরনের দায়িত্ব পায় সৌদি ইবন লাদেন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এখন এ প্রশস্তকরনের কাজ প্রতীয়মান। এ কাজ শেষ হতে ২০১৭-১৮ সাল লাগবে আশা করা যায়। বর্তমানে প্রায় ৩০-৩৫ লক্ষাধিক মুসল্লি একত্রে সালাত আদায় করতে পারেন এবং আশা করা যায় এ কাজ শেষ হলে প্রায় ৫০ লক্ষাধিক মুসল্লী একত্রে সালাত আদায় করতে পারবেন।

মক্কা ও মসজিদুল হারাম এর ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ‘পবিত্র মক্কার ইতিহাস: শাইখ ছফীউর রহমান মোবারকপুরী’ বইটি পড়ুন।

[1] সূরা আন-নাহল: ১৬:১১২

[2] সূরা আল-বালাদ: ৯০:১

[3] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৯২৫; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৩০৮

[4] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৩৯৬

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   আমাদের অজান্তেই আমরা মুনাফিক | মুনাফিক কি এবং মুনাফিকে পরিণত হওয়ার কারণ

 ✅তাওয়াফের তাৎপর্য
===============

তাওয়াফের সাধারণ অর্থ হলো – বায়তুল্লাহ বা কা‘বা আবর্তন করা।

কা‘বা ঘরের চারপাশে শরী‘আত নির্ধারিত পদ্ধতিতে ৭ বার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলা হয়। কা‘বা ঘর তাওয়াফ করার নেকী অপরিসীম।

পৃথিবীর বুকে আল্লাহর ইবাদাতের জন্য নির্মিত কা‘বা ঘরই ছিল প্রথম ঘর। পৃথিবীর আর কোনো ঘর তাওয়াফ করার জন্য আল্লাহ নির্দেশনা দেন নি।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈল-কে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের, ইতিকাফকারীদের, রুকু ও সাজদাহকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখে’’।[1]

এক হাদীসে তাওয়াফকে সালাতের সমতুল্য বলা হয়েছে। পার্থক্য শুধু এতটুকু, তাওয়াফের সময় কথা বলা বৈধ তবে প্রয়োজন ব্যাতিরেকে না বলাই উত্তম।

মহাবিশ্বের বৃহৎ শক্তির চারদিকে সকল ছোট বস্তু আবর্তন করে বা আল্লাহ কেন্দ্রিক মানবের জীবন বা মহান আল্লাহর নিদর্শন ও নিয়ামতের চারপাশে মানুষের বিচরণ বা এক আল্লাহ নির্ভর জীবনযাপনের গভীর অঙ্গিকার ব্যক্ত করা – এসবকিছুরই প্রতীক হচ্ছে তাওয়াফ। তাওয়াফ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আনুগত্য ও বশ্যতাকেই বুঝায়।

যদিও বেশিরভাগ উত্তম কাজ ডান থেকে বামে করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কা‘বা শরীফ তাওয়াফ করতে বলা হয়েছে বাম ধার ধরে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী এবং দেহের রক্ত চলাচল বাম থেকে ডানে হয়।

হজ ও উমরাহ উভয় ইবাদাতের জন্যই তাওয়াফ বাধ্যতামূলক। হজ বা উমরাহ পালনকারীকে যে কোনো উপায়ে (হেঁটে অথবা হুইল চেয়ারে বা কাঁধে চড়ে) তাওয়াফ সম্পন্ন করতে হয়।

ঋতুবর্তী মহিলারা তাওয়াফ করতে পারবেন না; তবে তারা হজ ও উমরাহর অন্যান্য কার্যাবলী সম্পাদন করতে পারবেন এবং তাদের ঋতু বন্ধ হওয়ার পর তারা তাওয়াফ করবেন।

কা‘বা ঘর সংলগ্ন একটি স্থান রয়েছে যার নাম হাতিম/হিজর – কা‘বা ঘরের উত্তর দিকে কা‘বা সংলগ্ন অর্ধ-বৃত্তাকার এ উচু দেওয়ালটিও কা‘বা ঘরেরই অংশ। এ হাতিমের মধ্য দিয়ে তাওয়াফ করলে তাওয়াফ হবে না। (বাহির অংশ দিয়ে তাওয়াফ করতে হবে)

সাধারণত তাওয়াফ ৪ ধরনের। যথা – তাওয়াফুল কুদুম (ইফরাদ ও ক্বিরান হাজীর প্রথম তাওয়াফ/তামাত্তু হাজীর উমরাহর তাওয়াফ), তাওয়াফুল ইফাদাহ/যিয়ারাহ (হজের ফরয তাওয়াফ), তাওয়াফুল বিদা (হজের বিদায় তাওয়াফ) ও নফল তাওয়াফ (ঐচ্ছিক তাওয়াফ)।

[1] সূরা আল-বাকারা: ২:১২৫

 ✅তাওয়াফের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও টিপস
========================

কাজ
থেকে
পর্যন্ত
প্রতি আবর্তন ও সর্বমোট দূরত্ব (আনুমানিক)
কা‘বা তাওয়াফ
(মাতাফ-প্রধান ফ্লোরে)
হাজরে আসওয়াদ
হাজরে আসওয়াদ
০.৩২ কি.মি ও ২.২৫ কি.মি
কা‘বা তাওয়াফ
(মাতাফের ২য় তলায়)
হাজরে আসওয়াদ
হাজরে আসওয়াদ
০.৪৫ কি.মি ও ৩.১২ কি.মি.
কা‘বা তাওয়াফ
(হারামের ২য় ও ৩য় তলায়)
হাজরে আসওয়াদ
হাজরে আসওয়াদ
০.৬৮ কি.মি ও ৪.৭৬ কি.মি.

যদি হজ শুরুর ৭-১০ দিনের মধ্যে উমরাহ করতে যান তবে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে পড়তে হতে পারে। এজন্য মসজিদের দুই অথবা তিন তলা দিয়ে প্রথম তাওয়াফ করা ভাল। তাছাড়া সাধারণত এশার সালাতের পরে বা মধ্যরাতে বা সকাল ৬টা থেকে ৯টার মধ্যে তাওয়াফ করা ভালো। এতে আপনি সালাতের সময়ে তাওয়াফ করা, সূর্যের তাপ ও অতিরিক্ত ভিড় এড়াতে পারবেন।

তাওয়াফের পূর্বে পানি কম করে পান করলে ভালো হয়। তাওয়াফের আগে টয়লেট/বাথরুম সেরে নেওয়া উত্তম। সঙ্গে মাসনুন দু‘আ-র বই নেওয়া যায়।

তাওয়াফ করার সময় স্যান্ডেল বহন করার জন্য ছোট কাপড়ের ব্যাগ/কাধ ব্যাগ সঙ্গে নিবেন। মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে সাথে নিবেন অথবা সাইলেন্ট মোডে দিয়ে রাখবেন। আপনার হোটেল বা বাড়ির ঠিকানা কার্ড সঙ্গে নেবেন। হজ আইডি কার্ড ও হাতের ব্যান্ড সঙ্গে রাখুন।

তাওয়াফের সময় ভিড়ের মধ্যে শান্ত থাকবেন। দরকার হলে কারো হাত ধরে রাখবেন। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে কষ্ট দেবেন না।

সবাই দলবদ্ধ হয়ে তাওয়াফ করার চেয়ে ছোট ছোট দল হয়ে তাওয়াফ করাই উত্তম। কারণ সবার গতি এক নয় আর মনোযোগ আল্লাহর যিকির করার চেয়ে দলের প্রতি থাকবে বেশি। তবে হারিয়ে যাওয়ার খুব ভয় থাকলে কথা ভিন্ন।

তাওয়াফের প্রথম দিনই হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করার চেষ্টা করবেন না। সাথে মহিলা থাকলে খুব কা‘বা ঘর ঘেষে তাওয়াফ করতে যাবেন না।

যখনই আযান শুনবেন তখনই তাওয়াফ/সা‘ঈ বন্ধ করে দিয়ে সালাতের প্রস্তুতি নিবেন। সালাত আদায় করে আবার সেখান থেকেই শুরু করে দেবেন।

 ✅মসজিদুল হারামে প্রবেশ ও কা‘বা তাওয়াফ
=======================


এবার তাওয়াফের জন্য প্রস্তুতি নিন। তাওয়াফের পূর্বে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হওয়া আবশ্যক। সকল প্রকার নাপাকী থেকে পবিত্র হতে হবে। মক্কার আসার পরে ও তাওয়াফের পূর্বে গোসল করা মুস্তাহাব। তবে শুধু ওযু করলেও চলবে। ওযু ছাড়া বা হায়েয নেফাস অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েয নয়। ইহরামের বিধি-নিষেধ স্মরণ রাখবেন এবং বেশি বেশি তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকবেন।

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   জেনে নিই হজ্জ ও উমরা এর বিস্তারিত(পর্ব ৫)।

মসজিদুল হারামের যাওয়ার রাস্তায় কিছু স্থান চিহ্নিত করুন ও সেখানে যাওয়ার পথ চিনে রাখতে চেষ্টা করুন। এতে করে আপনি যদি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন অথবা হারিয়ে যান তাহলে সহজেই বাসা বা হোটেলে ফিরে আসতে পারবেন।

আপনি যে কোনো গেট দিয়েই প্রবেশ করতে পারেন। তবে তাওয়াফ শুরু করার জায়গায় সহজে পৌছানোর জন্য সাফা পাহাড়ের পাশের গেট দিয়ে প্রবেশ করলে সহজ হয়। মসজিদে প্রবেশের আগে সেন্ডেল খুলে শেলফে রাখুন অথবা সঙ্গে ছোট ব্যগে নিয়ে নিতে পারেন।

ডান পা দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করুন এবং এ দো‘আ পাঠ করুন: بسم الله والصلاة والسلام على رسول الله اَللهم افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ

‘‘বিসমিল্লাহি ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাফ তাহলী আবওয়াবা রাহমাতিকা’’।
‘‘আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর।
হে আল্লাহ, আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দিন’’।

উমরাহর নিয়তে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলে ‘তাহিয়াতুল মসজিদ’ সালাত আদায় করার প্রয়োজন নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে সরাসরি তাওয়াফ করেছেন। কিন্তু অন্য কোনো সময়ে মসজিদে প্রবেশ করলে দু’রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ সালাত আদায় না করে মসজিদে যেন কেউ না বসেন; তবে কোনো সালাতের ইকামত হয়ে গেলে সেই সালাতে শামিল হয়ে যাবেন। এ নিয়ম সকল মসজিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।[1]

মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করে কা‘বার উদ্দেশ্যে যেতে যেতে তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকুন। যখনই কা‘বা শরীফ চোখে পড়বে তখনই তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করে তাওয়াফের প্রস্তুতি নিন ও তাওয়াফের নিয়ত করুন। কা‘বা শরীফ চোখে পড়া মাত্রই জোরে তাকবির দেওয়া বা দু হাত তুলে দো‘আ করা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাওয়াফের শুরুতে মনে মনে নিয়ত করবেন। নিয়তের জন্য মুখে কিছু বলতে হয় না, কোনো কাজের জন্য দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করাই হচ্ছে নিয়ত। এ তাওয়াফ করা উমরাহর ফরয কাজ।

তাওয়াফ শুরুর স্থানে (হাজরে আসওয়াদ কর্নার) যাওয়ার আগে শুধু পুরুষরা তাদের ইহরামের কাপড়ের এক প্রান্ত ডান বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের উপর দিবেন এবং ডান কাঁধ ও বাহু উন্মুক্ত করে দিবেন। একে বলা হয় ‘ইদতিবা‘’। সাত চক্বরেই এমনটি করা সুন্নাত। মেয়েদের কোনো ইদতিবা‘ নেই। এ ইদতিবা‘ শুধুমাত্র (তামাত্তু হাজীর) উমরাহর তাওয়াফ এবং (ক্বিরান ও মুফরিদ হাজীর) তাওয়াফে কুদুমের সময় করতে হয়। আর অন্য কোনো তাওয়াফের সময়ের জন্য ইদতিবা‘ করা প্রযোজ্য নয়।

এবার তাওয়াফ শুরুর স্থানে তাওয়াফকারীদের স্রোতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করুন। স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। কারণ এতে বিপরীত দিক থেকে আসা লোকের স্রোতে আঘাত পেতে পারেন ও আপনি তাওয়াফকারীদের তাওয়াফে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারেন।

তাওয়াফকারীদের সাথে চলতে চলতে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে লক্ষ্য করুন হাজরে আসওয়াদ এর কোণ/কর্নার বরাবর মাসজিদুল হারামের দেওয়ালে সবুজ রংয়ের আলোর বাতি দেওয়া আছে। এ সবুজ বাতি ও হাজরে আসওয়াদের কোণ বরাবর পৌছলে বা তার একটু আগেই সম্ভব হলে একটু থেমে বা চলতে চলতেই হাজরে আসওয়াদ এর দিকে মুখ করে ডান হাত উচু করে হাজরে আসওয়াদের দিকে সোজা ধরে বলুন: بِسْمِ اللهِ اَللهُ أَكْبَرُ ‘‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’’।

তাকবীর বলার পর আপনার ডান হাত নিচে নামিয়ে নিন ও রমল (দ্রুত পদক্ষেপে বীরত্ব প্রকাশ) করে চলতে শুরু করুন। হাতে কোনো চুমু খাবেন না। অনেককে লক্ষ্য করবেন এক/দুই হাত উচু করে তাকবীর বলছেন ও হাতে চুমু খাচ্ছেন, এমনটি করা সঠিক সুন্নাত নিয়ম নয়।[2]

হাজরে আসওয়াদ পাথর চুম্বন করে তাওয়াফ শুরু করা উত্তম ও এমনটি করা সুন্নাত। তবে যদি চুমু খেতে না পারেন তাহলে ডান হাত দিয়ে পাথরটি স্পর্শ করে আপনার হাতে চুমু দিয়ে তাওয়াফ শুরু করতে পারেন। কিন্তু হজ মৌসুমে অতিরিক্ত ভিড় ও ধাক্কাধাক্কির কারণে হাজরে আসওয়াদ এর ধারে কাছেই যাওয়া যায় না, তাই আপনাকে দূর থেকে ইশারা করেই তাওয়াফ শুরু করার পরামর্শ দিব। পরবর্তীতে আপনি যখন নফল তাওয়াফ করবেন তখন যতদূর সম্ভব ধাক্কাধাক্কি না করে ও কাউকে কষ্ট না দিয়ে হাজরে আসওয়াদ পাথর চুম্বন করার চেষ্টা করতে পারেন।

হাজরে আসওয়াদ পাথর স্পর্শের ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, এ পাথর স্পর্শ করলে গুনাহসমূহ (সগীরা গুনাহ) সমূলে মুছে যায় ও এ পাথর হাশরের ময়দানে সাক্ষী দিবে যে ব্যক্তি তাকে স্পর্শ করেছে।[3]

এবার কা‘বাকে আপনার বাম দিকে রেখে আবর্তন/চক্কর দিতে শুরু করুন। হাজারে আসওয়াদ কর্নার এর সবুজ বাতি থেকে শুরু করে কা‘বা ঘরের ইরাকি কর্নার, হাতিম, সামি কর্নার, ইয়েমেনি কর্নার পার করে ফের হাজরে আসওয়াদ কর্নার এর সবুজ বাতি পর্যন্ত হাঁটা শেষ হলে এক চক্কর গণনা করা হয়। এভাবে আরও ছয় চক্কর দিতে হবে। এ সাত চক্কর সম্পন্ন হলে তাওয়াফ শেষ হয়ে যাবে।

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   জেনে নিই হজ্জ ও উমরা এর বিস্তারিত(পর্ব ৭)।

শুধুমাত্র পুরুষেরা চক্করের শুরুতে দৃঢ়তার সাথে বীর বেশে কাঁধ হেলিয়ে প্রথম তিন চক্কর সম্পন্ন করবেন অর্থাৎ; একটু দ্রুত ও ক্ষুদ্র কদমে বুক টান করে জগিং করে/হেঁটে ‘রমল’ করে চক্কর সম্পন্ন করবেন, এমনটি করা সুন্নাত। তবে ভিড়ের কারণে রমল করা সম্ভব না হলে কোনো সমস্যা নেই, আপনি স্বাভাবিকভাবেই হাঁটবেন। এ রমল করা শুধুমাত্র (তামাত্তু হাজীর) উমরাহর তাওয়াফ ও (অন্যান্য হাজীর) তাওয়াফে কুদূমের জন্য প্রযোজ্য। আর অন্য কোনো তাওয়াফের সময় রমল করতে হয় না। চতুর্থ চক্কর থেকে আপনি আবার স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে শুরু করবেন এবং এ ধারা বজায় রাখবেন সপ্তম চক্কর পর্যন্ত। মহিলাদের কোনো রমল নেই।

তাওয়াফের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দো‘আ নেই। কিছু কিছু বইতে দেখবেন; প্রথম চক্রের দো‘আ, দ্বিতীয় চক্রের দো‘আ.. লেখা থাকে। কুরআন হাদীসে এধরনের চক্রভিত্তিক দো‘আর কোনো দলীল নেই। তাওয়াফরত অবস্থায় আপনি ইচ্ছে করলে কুরআন তিলাওয়াত, দো‘আ, যিকির, ইসতিগফার করতে পারেন আপনার নিজের ইচ্ছা মত। আল্লাহর প্রশংসা করুন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দুরূদ পড়ুন। সব দো‘আ যে আরবীতে করতে হবে তার কোনো নিয়ম নেই, যে ভাষা আপনি ভালো বোঝেন ও আপনার মনের ভাব প্রকাশ পায় সে ভাষাতেই দো‘আ করুন। তবে মনে রাখবেন; আওয়াজ করে, জোরে শব্দ করে বা দলবদ্ধ হয়ে কোনো দো‘আ পাঠ করা সুন্নাত নিয়ম এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এতে অন্যদের মনোযোগও নষ্ট হয়। দো‘আ করবেন আবেগ ও মিনতির সাথে মনে মনে। তাওয়াফের সময় তাওহীদকে জাগ্রত করুন। তাওয়াফের সময় এদিক ওদিক তাকাতাকি ও ঘুরাঘুরি না করে একাগ্রচিত্তে বিনয় এর সাথে তাওয়াফ করাই উত্তম। খুব বেশি প্রয়োজন ব্যাতিরেকে তাওয়াফের সময় কথা না বলাই শ্রেয়। এ বইয়ের শেষে কুরআন ও হাদীস থেকে বেশ কিছু দো‘আ সংযোজন করা হয়েছে যা তাওয়াফের সময় পড়তে পারেন।

তাওয়াফ করার সময় পুরুষ ও মহিলা একত্রিত হয়ে একই জায়গায় তাওয়াফ করতে হয়, তাই তাওয়াফ করার সময় বেগানা পুরুষ মহিলার গায়ের সাথে ধাক্কা লাগা বা স্পর্শ লাগতে পারে তাই আপনাকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে এবং এ বিষয়গুলো সর্বাত্নক এড়িয়ে চলতে হবে। অবস্থা বুঝে একটু ভিড় এড়িয়ে তাওয়াফ করা উত্তম। কিছু লোক বা দল তাওয়াফের সময় একে অন্যের হাত ধরে ব্যারিকেড/বৃত্ত বানিয়ে সেই বৃত্তের মাঝে মহিলাদের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন যাতে তারা হারিয়ে না যান। এমন করা ঠিক নয় কারণ এতে অন্যদের তাওয়াফ ব্যাহত হয়। দলনেতা একটি ছোট পতাকা বা ছাতা নিয়ে সামনে থাকতে পারেন এবং অন্যরা তাকে অনুসরণ করতে পারেন অথবা একে অন্যের হাত ধরে ছোট ছোট দল করে তাওয়াফ করতে পারেন।

তাওয়াফরত অবস্থায় প্রতি চক্করে ইয়েমেনী কর্নারে পৌঁছানোর পর আপনি ডান হাত অথবা দুই হাত দিয়ে কা‘বার ইয়েমেনী কর্নার শুধু স্পর্শ করবেন (এমনটি করা সুন্নাত), তবে ভিড়ের কারণে এটা করা সম্ভব না হলে কোনো সমস্যা নেই। আপনি চক্কর চালিয়ে যাবেন। দূর থেকে হাত উঠিয়ে ইশারা করবেন না বা চুম্বন করবেন না কিংবা আল্লাহু আকবারও বলবেন না।

প্রত্যেক চক্করে ইয়েমেনী কর্নার থেকে হাজারে আসওয়াদ কর্নার এর মাঝামাঝি স্থানে থাকাকালে এ দো‘আ পাঠ করা মুস্তাহাব ও সুন্নাত:

رَبَّنَا اٰتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الْاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ
‘‘রাববানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাহ, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাহ, ওয়াক্বিনা আযাবান নার’’।
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ
দান করুন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন”।[4]

প্রথম এক চক্কর শেষ করে হাজরে আসওয়াদ কর্নার পৌঁছার পর আবার আগের মতো করে দূর থেকে ডান হাত উচু করে তাকবীর দিয়ে দ্বিতীয় চক্কর শুরু করবেন। এক্ষেত্রে শুধু মনে রাখবেন ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ না বলে শুধু বলবেন ‘আল্লাহু আকবার’। এমনটি পরবর্তী সকল চক্কর এর শুরুতে বলবেন।

উপরোক্ত নিয়মানুযায়ী সাত চক্কর শেষ করবেন। এভাবে আপনার তাওয়াফ সম্পন্ন করবেন। তাওয়াফ শেষে মাতাফ থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে কোনো ফাঁকা স্থানে অবস্থান গ্রহন করুন।

তাওয়াফ শেষ হওয়া মাত্রই পুরুষরা তাদের ডান কাঁধ ইহরামের কাপড় দিয়ে ঢেকে দেবেন। এবার আপনি ‘ইদতিবা‘’ থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন।

[1] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৫৫

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬০৭

[3] ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২৭২৯

[4] সূরা আল-বাকারা: ২:২০১

MuslimPoint Organization

About MuslimPoint Organization

MuslimPoint একটি অনলাইন ভিত্তিক ইসলামী প্রশ্নোত্তর, গ্রন্থাগার, ব্লগিং, কুরআন, হাদিস, কুইজ এবং বিষয় ভিত্তিক রেফারেন্স প্ল্যাটফর্ম।

View all posts by MuslimPoint Organization →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *