যে রহস্যময় ধর্মীয় সংগঠনে ৯০৯ জন একই সাথে আত্নহত্যা করে | পিপলস টেম্পল (Peoples Temple)

পিপলস টেম্পল (Peoples Temple)
যে রহস্যময় ধর্মীয় সংগঠনে ৯০৯ জন একই সাথে আত্নহত্যা করে | পিপলস টেম্পল (Peoples Temple)

আজকে আমরা এমন একটি ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠী সম্পর্কে জানবো যেখানে একই সাথে এবং একই সময়ে প্রায় ৯০৯ জন মারা গিয়েছিলো। এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, যারা মারা গিয়েছিলো তাদের মধ্যে অনেকেই নিজ ইচ্ছাই আত্নহত্যা বা suicide করেছিলো এবং বাকিদের জোরপূর্বক হত্যা করা হয়েছিলো। এখন মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে প্রথমত সেই রহস্যময় ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠী সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক। 

[আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এই বিষয়ে একটি ভিডিও আছে। চাইলে সেটা এখানে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন।]

মূলত এটি ছিলো একটি আমেরিকান (American) ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠী যেটা পিপলস টেম্পল (Peoples Temple) নামে বেশি পরিচিত ছিলো। সংক্ষেপে এটিকে পিপলস টেম্পল (Peoples Temple) বলা হলেও এটা পিপলস টেম্পল অফ ডিসাইপিলস অফ খ্রীষ্ট(Peoples Temple of the Disciples of Christ) বা পিপলস টেম্পল ফুল গসপেল চার্চ (Peoples Temple Full Gospel Church) নামেও বেশ পরিচিত।

প্রকৃতপক্ষে এই ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে। এর পর এই ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না। ঠিক কি কারণে এরা অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে বা সেই সময়ে ঠিক কি ঘটেছিলো যার কারণে বর্তমানে তাদের সেই ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর কোন অনুসারীকেও আর খুজে পাওয়া যায় না সে সম্পর্কেও আমরা জানার চেষ্টা করবো ।

এই পিপলস টেম্পল (Peoples Temple) নামের ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠীটি প্রথম আত্নপ্রকাশ করে ইন্ডিয়ানাপলিস (Indianapolis) নামক একটি স্থানে যেটি ছিলো United States এর ইন্ডিয়ানা (Indiana) নামক State এর ক্যাপিটাল (capital) এবং অনেক জনপ্রিয় একটি শহর। এই রহস্যজনক ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জিম জোন্স (Jim Jones) নামের এক ব্যক্তি যিনি ছিলেন আমেরিকার ধর্মপ্রচারক এবং একজন সুপরিচিত রাজনৈতিক কর্মী।

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   মূসা (আ.) এর সাথে আবেদ ও পাগলের প্রচলিত মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট গল্প বা কাহিনী বা কিসসা

মূলত এই পিপলস টেম্পল (Peoples Temple) নামের ধর্মীয় সংগঠন যে মেসেজ বা বাণী প্রচার করতো তা ছিলো খ্রিস্টধর্ম বা Christianity, কমিউনিস্ট (communist) এবং সমাজতান্ত্রিক বা socialist এর মিশ্রণ।

প্রথমদিকে তাদের একটি মাত্র শাখা থাকলেও পরবর্তীতে ১৯৬০ সালের দিকে আমেরিকার বিভিন্ন State এ তারা বেশ কয়েকটি শাখা তৈরি করে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সেই সময়ে এই ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠীটি অনেক বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল এবং তারা দাবি করতো যে তাদের প্রায় ২০ হাজারের মতো সদস্য আছে। কিন্তু বিভিন্ন সার্ভে বা গণনা থেকে জানা যায় যে, তাদের প্রকৃত সদস্য সংখ্যা ছিলো ৪ থেকে ৫ হাজারের মতো।

এখন আসুন মূল ঘটনায়, এই পিপলস টেম্পল (Peoples Temple) নামক ধর্মীয় সংগঠন কে কেন্দ্র করে ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর একটি ভয়াবহ এবং রহস্যজনক ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি হয়েছিলো জোন্সটাউন (Jonestown), গায়ানাতে (Guyana)। যেখানে একই সাথে এবং একই সময়ে প্রায় ৯০৯ জন মারা গিয়েছিলো। এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, যারা মারা গিয়েছিলো তাদের মধ্যে অনেকেই নিজ ইচ্ছাই আত্নহত্যা বা suicide করেছিলো এবং বাকিদের কে জোরপূর্বক হত্যা করা হয়েছিলো। এই ভয়াবহ এবং রহস্যজনক ঘটনাটি ইতিহাসে বিপ্লবী আত্মহত্যা বা revolutionary suicide নামেও পরিচিত। এখন চলুন ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

সেই সময়ে এই রহস্যজনক ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা জিম জোন্স (Jim Jones) এর নামে বিভিন্ন কারণে অনেক অভিযোগ বা allegations আনা হয়। তখন জিম জোন্স (Jim Jones) ছিলো জোন্সটাউন (Jonestown), গায়ানাতে (Guyana)। যখন জিম জোন্স (Jim Jones) জানতে পারে যে তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ বা allegations আনা হয়েছে এবং হয়তো খুব শিঘ্রই তার এসব অভিযোগ তদন্ত বা investigation করার জন্য অনেকে সেখানে আসবে এজন্য সে সেখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এবং ঠিক একারণেই সেই সময়ে জিম জোন্স (Jim Jones) তার টেম্পল (Temple) সদস্যদের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলো এই মর্মে যে “আমরা আজ রাতে চলে যাবো” । এখন জিম জোন্স (Jim Jones) এরপরে সেখান থেকে অর্থাৎ গায়ানা (Guyana) থেকে চলে যায়। এবং যাওয়ার আগে সে তার সেখানকার টেম্পল সদস্যদের কে উৎসাহিত করে তাকে অনুসরণ করার জন্য। এখানে বলে রাখা ভালো হবে যে, প্রথম দিকে সেখানে সদস্য সংখ্যা কম থাকলেও ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে সদস্য সংখ্য বেড়ে ৯০০ জনের মতো হয়ে যায় এবং তাদের সবাইকে তখন জিম জোন্স (Jim Jones) কে অনুসরণ করার বিনিময়ে স্বর্গ (paradise) তে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো।

এখন ১৯৭৮ সালের ১৭ নভেম্বর, লিও রায়ান (Leo Ryan) নামের এক ব্যক্তি জোন্সটাউন (Jonestown) এর টেম্পল (Temple) পরিদর্শনে গিয়েছিলেন টেম্পল (Temple) সম্পর্কে যে অভিযোগ আছে সেটার তদন্ত বা investigation করার জন্য। এরপরে টেম্পল (Temple) পরিদর্শনের সময়, টেম্পল এর বেশ কয়েকজন সদস্য লিও রায়ান (Leo Ryan) নামের ওই ব্যক্তির সাথে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং 18 নভেম্বর, কয়েকজনকে সাথে নিয়ে লিও রায়ান স্থানীয় বিমানঘাঁটিতে যান। সেখানে তারা টেম্পল (Temple) এর নিরাপত্তারক্ষীদের দ্বারা আটকা পড়েন এবং নিরাপত্তারক্ষীরা লিও রায়ানসহ পুরো দলটির উপর হঠাৎ গুলি চালায় এবং এর ফলে লিও রায়ানসহ তিন সাংবাদিক এবং একজন দলত্যাগী মারা যায় এবং সেখানে আরও অনেকে আহত হয়। এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সেই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও ধারণ করেছিলেন এনবিসি (NBC) ক্যামেরাম্যান বব ব্রাউন (Bob Brown), তিনিও ওইদিন হামলায় মারা গিয়েছিলেন। এখন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, সেইদিন সন্ধ্যায় জিম জোন্স (Jim Jones), যে ছিলো এই পিপলস টেম্পল (Peoples Temple) ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠীটির প্রতিষ্ঠাতা, তিনি তার সদস্যদের আদেশ করেন সায়ানাইড-লেসযুক্ত (cyanide-laced) বিষাক্ত পানীয় পান করার জন্য। আর যেহুতু টেম্পল (Temple) এর সদস্যরা জিম জোন্স (Jim Jones) কে অনুসরণ করতো এজন্য হয়তো তারা ভেবেছিলো যে এটি পান করার ফলে তারা মারা গেলেও স্বর্গ (paradise) পাবে কারণ অতীতে জিম জোন্স (Jim Jones) কে অনুসরণ করার বিনিময়ে তাদেরকে স্বর্গ (paradise) তে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো। এজন্য অনেকে তখন ওই সায়ানাইড-লেসযুক্ত (cyanide-laced) বিষাক্ত পানীয় পান করেন। এবং দুঃখের বিষয় হলো যারা পান করতে অস্বীকার করে তাদের কে জোর করে পান করানো হয়। অনেক বাচ্চা বা শিশুকে ইনজেকশন দিয়ে এটি পুশও করা হয়। এর ফলে প্রায় ৯০০ জনেরও বেশি মানুষ সাথে সাথেই মারা যায়। এর মধ্যে প্রায় ২০০ জনেরও বেশি ছিলো ছোট বাচ্চা বা শিশু। পরবর্তীতে জিম জোন্স (Jim Jones) নিজেও মাথায় বন্দুকের গুলি লেগে মারা গিয়েছিল, বলা হয়ে থাকে তিনিও আত্নহত্যা করেছিলেন। এখন তিনি ঠিক কি কারণে এমন ভয়ঙ্কর কাজ করেছিলেন সেটি সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। তবে বলা হয়ে থাকে তার এবং টেম্পল (Temple) এর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিলো সেগুলির সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি এমনটা করতে পারেন। তবে যাই হোক, সত্যিই এটি ছিলো আমেরিকান বেসামরিক জীবনের জন্য একটা ভয়ঙ্কর কালো অধ্যায়।

কোথায় যাচ্ছেন? আরো নতুন কিছু জানার জন্য এই লেখাটি পড়ুনঃ   সমাজে প্রচলিত কিছু শিরক এর তালিকা জেনে নিই (পর্ব ৮)।

শেষ করার আগে, আত্নহত্যা বিষয়ক কুরআনের একটি আয়াত আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, আল্লাহু-তায়ালা বলেনঃ
তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর এবং স্বহস্তে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না । এবং কল্যাণকর কাজ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ কল্যাণকারীদেরকে ভালবাসেন। (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ১৯৫)।

MuslimPoint Organization

About MuslimPoint Organization

MuslimPoint একটি অনলাইন ভিত্তিক ইসলামী প্রশ্নোত্তর, গ্রন্থাগার, ব্লগিং, কুরআন, হাদিস, কুইজ এবং বিষয় ভিত্তিক রেফারেন্স প্ল্যাটফর্ম।

View all posts by MuslimPoint Organization →

One Comment on “যে রহস্যময় ধর্মীয় সংগঠনে ৯০৯ জন একই সাথে আত্নহত্যা করে | পিপলস টেম্পল (Peoples Temple)”

  1. আপনি কি ঐ ব্যাক্তি যিনি ইসলামিক ফেইথ কালচারাল বিডির লেখক? আপনার পেইজে কত চেষ্টা করেছি ডুকতে কিন্তুু পারছিলামনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *