সংক্ষেপে ঃ
এ বিষয়ে ফকিহদের মাঝে দু’টো মত রয়েছে। কেউ বলেছেন যে কুরবানি ওয়াজিব । আবার কেউ বলেছেন যে কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বা অত্যন্ত তাকিদপূর্ণ সুন্নাহ। উভয়পক্ষের দলিল বলিষ্ঠ। যাতে কোন একটার প্রতি পক্ষপাতিত্ব সহজ নয়। তবে সকল দলিল বিশ্লেষন করলে দেখা যায় " কুরবানি হলো সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ ( তাকিদপূর্ণ সুন্নাহ। ) " এই মতটি বেশি শক্তিশালী ও অধিকাংশ সাহাবা, তাবিয়িন এবং ফকিহগণের মত । নিচে বিস্তারিত দলিল সহ আলোচনা করা হলো ।
বিস্তারিত ঃ
কুরবানির হুকুম কি? ওয়জিব না সুন্নাহ? এ বিষয়ে ফকিহদের মাঝে দু’টো মত রয়েছে।
প্রথম মত: কুরবানি ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ি, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখের মত এটা। আর ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদের একটি মতেও কুরবানি ওয়াজিব।
দ্বিতীয় মত: কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বা অত্যন্ত তাকিদপূর্ণ সুন্নাহ। এটা অধিকাংশ আলিমদের মত। ইমাম মালিক ও শাফিয়ির প্রসিদ্ধ মত। কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি পরিত্যাগ করা মাকরুহ। যদি কোন জনপদের লোকেরা সমর্থ্য হওয়া সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কুরবানি পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কুরবানি হলো ইসলামের একটি শিয়ার বা মহান নিদর্শন।[2]
আল্লামা ইবনু উসাইমিন (রহ.) উভয় পক্ষের দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করার পর বলেন, ‘এ সকল দলিল-প্রমাণ পরস্পর বিরোধী নয়; বরং একটা অন্যটার সম্পূরক।’ তাছাড়া, উভয়পক্ষের দলিল সমানভাবে বলিষ্ঠ। যাতে কোন একটার প্রতি পক্ষপাতিত্ব সহজ নয়। এ কারণে কিছু আলিম কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার পক্ষ সমর্থন করেন। তাদের মধ্যে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া অন্যতম। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবা, তাবিয়িন এবং ফকিহগণের মতে কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা (তাকিদপ্রাপ্ত সুন্নাত)। অবশ্য মুসলিমের জন্য উচিত হচ্ছে, সামর্থ্য থাকলে কুরবানি ত্যাগ না করা। উচিত নিজের ও পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে কুরবানি করা। যাতে আল্লাহর আদেশ পালনে এবং মহানবির অনুকরণে বিরাট সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়।
------------------
যারা কুরবানি ওয়াজিব বলেন তাদের দলিল ও তাহকীক
------------------
১. আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন,
﴿فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ﴾
‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও পশু কুরবানি করো।’[ সুরা কাওসার : ২]
আর আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো ব্যাপারে নির্দেশ দেন সাধারণত সেটা পালন করা ওয়াজিবই হয়ে থাকে।
২. আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
«مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا»
‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারেকাছেও না আসে।’ [সুনানে ইবনে মাজাহ (৩১২৩) , আহমাদ, আলমুসনাদ : ১৬/৪৬৬; ]
[তাহকীক ঃ
হাদিস বিশারদ ইমামগণের অনেকে এ হাদিসকে মারফু হাদিস হিসেবে মেনে নেননি। বরং তারা এটাকে আবু হুরায়রা (রাঃ) এর উক্তি হিসেবে হুকুম দিয়েছেন; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হিসেবে নয়।
বাইহাকী তার সুনান গ্রন্থে (৯/২৬০) বলেন: আমার কাছে আবু ঈসা তিরমিযি থেকে সংবাদ পৌঁছেছে যে, তিনি বলেন: সঠিক মতানুযায়ী এটি আবু হুরায়রা (রাঃ) এর উক্তি। তিনি বলেন: জাফর বিন রাবিআ ও অন্যান্য রাবীগণ এ হাদিসটিকে আব্দুর রহমান আল-আরাজ এর সূত্রে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে মাওকুফ হাদিস (সাহাবীর বাণী) হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[সমাপ্ত]
হাফেয ইবনে হাজার বলেন: ইবনে মাজাহ ও ইমাম আহমাদ হাদিসটি সংকলন করেছেন। সনদের রাবীগণ সকলে ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য)। কিন্তু, হাদিসটি কি মারফু হাদিস; নাকি মাওকুফ হাদিস এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মাওকুফ এর অভিমতটিই শুদ্ধতার অধিক নিকটবর্তী। ইমাম তাহাবী ও অন্যান্য হাদিসবিদ এ কথা বলেছেন। এরপরেও হাদিসটি কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে সুস্পষ্ট দলিল নয়।[ফাতহুল বারী (১২/৯৮) থেকে সমাপ্ত]
এ হাদিসকে মাওকুফ হাদিস হিসেবে অগ্রগণ্যতা দিয়েছেন: ইবনে আব্দুল বার্র, আব্দুল হক্ব তার 'আহকামুল উসতা' গ্রন্থে (৪/১২৭), আল-মুনযিরি 'আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব' গ্রন্থে, ইবনে আব্দুল হাদী 'আত-তানকীহ' গ্রন্থে (২/৪৯৮), দেখুন: সুনানে ইবনে মাজাহ এর মুহাক্কিকগণ কর্তৃক লিখিত টীকাসমূহ (৪/৩০৩)] ]
৩. আবু রামলা কর্তৃক মিখনাফ বিন সুলাইম থেকে বর্ণনাকৃত মারফু হাদিস: "হে লোকসকল! প্রত্যেক পরিবারের উপর আবশ্যক হল প্রতি বছর একটা কোরবানী করা ও একটা আতিরা দেয়া"।[সুনানে আবু দাউদ (২৭৮৮), সুনানে তিরমিযি (১৫৯৬) ও সুনানে ইবনে মাজাহ (৩১২৫)]
[
তাহকিকঃ
আতিরা: প্রত্যেক রজব মাসে তারা একটা পশু জবাই করত। এটাকে 'রজবিয়্যা'ও বলা হত।
একদল আলেম এ হাদিসটিকে যয়ীফ (দুর্বল) বলেছেন। যেহেতু 'আবু রামলা' যার নাম হচ্ছে‑ আমের; অজ্ঞাত পরিচয়।
আল-খাত্তাবি বলেন: এ হাদিসটির সনদ যয়ীফ (দুর্বল)। আবু রমলা লোকটি 'মাজহুল' (অজ্ঞাত পরিচয়)।[মাআলিমুস সুনান (২/২২৬) থেকে সমাপ্ত]
আয্-যাইলাঈ বলেন: আব্দুল হক্ব বলেছেন: এর সনদ যয়ীফ (দুর্বল)। ইবনুল কাত্তান বলেছেন: এ হাদিসের ইল্লত বা সমস্যা হল‑ 'আবু রমলা' যার নাম হচ্ছে‑ আমের; এ রাবীর অবস্থা অজ্ঞাত থাকা। কারণ এ ব্যক্তিকে শুধু এ সনদেই পাওয়া যায়। তার থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইবনে আউন।[নাসবুর রাইয়া (৪/২১১) থেকে সমাপ্ত]
]
সারকথা: যে হাদিসগুলো দিয়ে কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে দলিল দেয়া হয় সেগুলো সমালোচনা মুক্ত নয়; যদিও কোন কোন আলেম সেসব হাদিসের কোনটিকে 'হাসান' বলেছেন।
------------------
যারা কুরবানি সুন্নাত বলেন তাদের দলিল ও তাহকিক
------------------
১. উম্মু সালামা (রা.) বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
«إِذَا رَأَيْتُمْ هِلالِ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعَرِهِ وَأَظْفَارِهِ»
‘তোমাদের মাঝে যে কুরবানি করতে চায়, যিলহয মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানি সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নাখ না কাটে।’ [ মুসলিম, আসসাহিহ : ১৯৭৭ ]
[
ইমাম শাফেয়ি বলেন: "কোরবানী করা যে, ওয়াজিব নয় এ হাদিসটি তার দলিল। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন "ইচ্ছুক"। তিনি বিষয়টিকে "ইচ্ছা"-এর সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। যদি কোরবানী করা ওয়াজিব হত তাহলে তিনি বলতেন: সে যেন কোরবানী করা অবধি চুলে হাত না দেয়"[আল-মাজমু (৮/৩৮৬) থেকে সমাপ্ত]
]
[
তাহকিক ঃ
কিন্তু, এ দলিল দান প্রক্রিয়া সমালোচনা মুক্ত নয়। কারণ ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত করাটা ওয়াজিব না হওয়ার পক্ষে কোন দলিল নয়।
কিন্তু, এটার জবাব ঃ
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন:
"আমার মতে, ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত করাটা ওয়াজিব হওয়াকে নাকচ করে না; যদি ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে অন্য দলিল পাওয়া যায়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মীকাতের ক্ষেত্রে বলেছেন: "এ মীকাতগুলো তাদের জন্য যারা এ স্থানগুলোতে বসবাস করে কিংবা অন্য স্থানের অধিবাসীদের যারা এ স্থানগুলোর উপর দিয়ে গমন করে, যারা হজ্জ ও উমরা পালনে ইচ্ছুক"। এ হাদিসে ইচ্ছা শব্দের উল্লেখ থাকলেও অন্য দলিল দিয়ে হজ্জ ও উমরা ওয়াজিব হওয়ার পথে এটি প্রতিবন্ধক হয়নি। যেহেতু সামর্থ্যহীন ব্যক্তির কোরবানী করার ইচ্ছা থাকে না; তাই সকল মানুষকে কোরবানী করতে ইচ্ছুক ও অনিচ্ছুক এ দুইভাগে ভাগ করা সঠিক হয়েছে। এটি সামর্থ্য থাকা ও না-থাকার দৃষ্টিকোণ থেকে।[আহকামুল উযহিয়্যা ওয়ায যাকাত, পৃষ্ঠা-৪৭)]
]
২. এটি সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। এটি ওয়াজিব নয় যে, যেকোন মূল্যে প্রত্যেককে কুরবানী করতেই হবে। লোকেরা যাতে এটাকে ওয়াজিব মনে না করে, সেজন্য সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হযরত আবুবকর ছিদ্দীক, ওমর ফারূক, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস, বেলাল, আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবীগণ কখনো কখনো কুরবানী করতেন না। [ মির‘আত ৫/৭১-৭৩ ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদের আলোচনা দ্র. ]
৩. রাসূল (সা.) তার উম্মতের যারা কুরবানি করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করেছেন। এদ্বারাও বোঝা যায়, কুরবানি ওয়াজিব নয়।
-----------------------
এখন আসুন , শেষ ফলাফল দেখা যাক
-----------------------
কোরবানী করা ওয়াজিব নয় বরং এটা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ ( তাকিদপূর্ণ সুন্নাহ। ) এর পক্ষে শক্তিশালী দলীল গুলো নিন্মরূপ ঃ
১. আদি দায়মুক্তি: যেহেতু কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে সংঘর্ষমুক্ত কোন দলিল পাওয়া যায়নি তাই মূল অবস্থা হল‑ কোরবানী ওয়াজিব না হওয়া।
শাইখ বিন বায বলেন: সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কোরবানী করা সুন্নত; ওয়াজিব নয়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদা-কালো রঙের দুটো ভেড়া দিয়ে কোরবানী করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের জীবদ্দশায় ও তাঁর মৃত্যুর পরে সাহাবায়ে কেরামও কোরবানী করেছেন। এভাবে তাদের পরবর্তীতে মুসলিম উম্মাহ কোরবানী করেছে। কিন্তু, শরয়ি দলিলে এমন কিছু পাওয়া যায় না যা প্রমাণ করে যে, কোরবানী করা ওয়াজিব। সুতরাং ওয়াজিব বলার অভিমত দুর্বল।[মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বায (১৮/৩৬)]
২. সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত সহিহ আছারগুলো:
আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তারা কোরবানী করতেন না; না জানি মানুষ কোরবানী করাকে ওয়াজিব ভাবে‑ এটাকে অপছন্দ করে।
ইমাম বাইহাকী 'মারিফাতুস সুনান ওয়াল আছার' গ্রন্থে (১৪/১৬, নং- ১৮৮৯৩) আবু সারিহা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: "আমি আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ) কে পেয়েছি। তারা দুইজন আমার প্রতিবেশি ছিলেন। তারা দুইজন কোরবানী করতেন না।"
এরপর বাইহাকী বলেন: আমরা সুনান গ্রন্থে সুফিয়ান বিন সাঈদ আস্-ছাওরির হাদিস বর্ণনা করেছি, যা তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, এবং মুতার্রিফ-এর হাদিস বর্ণনা করেছি এবং ইসমাইল-এর সূত্রে শাবী-এর হাদিস বর্ণনা করেছি। তাদের কারো কারো হাদিসে রয়েছে যে, লোকেরা তাদের দুইজনকে অনুকরণ করার ভয়ে।
[আরও দেখুন: আস্-সুনান আল-কুবরা (৯/৪৪৪)]
ইমাম নববী 'আল-মাজমু' গ্রন্থে (৮/৩৮৩) বলেন: পক্ষান্তরে, আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছারটি ইমাম বাইহাকী ও অন্যান্য আলেমগণ 'হাসান' সনদে বর্ণনা করেছেন।[সমাপ্ত]
হাইছামী বলেন: এ আছারটি তাবারানী 'আল-কাবির' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এ আছারের সনদের রাবীগণ সকলে সহিহ হাদিসের রাবী।[মাজমাউয যাওয়ায়েদ (৪/১৮) থেকে সমাপ্ত; শাইখ আলবানী 'আল-ইরওয়া' (৪/৩৫৪) আছারটিকে সহিহ বলেছেন]
বাইহাকী (৯/৪৪৫) তার নিজস্ব সনদে আবু মাসউদ আল-আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: আমি সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও কোরবানী করি না‑ এই ভয়ে যে, আমার প্রতিবেশীরা মনে করবে, কোরবানী করা আমার উপর অপরিহার্য।[আলবানী 'আল-ইরওয়া গ্রন্থে এ আছারটিকেও সহিহ বলেছেন]
[1] ইবনু কুদামা, আলমুগনি, ১৩/৩৬০; আসকালানি, ফাতহুল বারি, ১০/৩
[2] ইবনু উসাইমিন, আহকামুল উদহিয়্যাহ, পৃ. ২৬