নাজাতপ্রাপ্ত দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, আকীদা, ইবাদাত, চরিত্র ও আচার ব্যবহারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে আকঁড়ে ধরা।
আপনি দেখতে পাবেন যে, আকীদার ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর অনুসারী। উলুহিয়্যাত, রুবূবিয়্যাত এবং আসমা ওয়াস সিফাতের[1] ক্ষেত্রে তারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সঠিক বিশ্বাস পোষণ করে থাকেন।
ইবাদাতের ক্ষেত্রে আপনি দেখতে পাবেন যে, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নকারী। ইবাদাতের প্রকার, পদ্ধতি, পরিমাণ, সময়, স্থান এবং ইবাদাতের কারণ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ করাই তাদের বৈশিষ্ট্য। আপনি তাদের নিকট দীনের ব্যাপারে কোনো বিদ‘আত খুঁজে পাবেন না। তারা আল্লাহ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সর্বোচ্চ আদব রক্ষা করে চলেন। আল্লাহ অনুমতি দেন নি, ইবাদাতের ক্ষেত্রে এমন বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তারা আল্লাহ এবং রাসূলের অগ্রণী হয় না।
আখলাক-চরিত্রের ক্ষেত্রেও আপনি তাদেরকে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী দেখতে পাবেন। মুসলিমদের কল্যাণ কামনা করা, অপরের জন্য উদার মনের পরিচয় দেওয়া, মানুষের সাথে হাসি মুখে কথা বলা, উত্তম কথা বলা, বদান্যতা, বীরত্ব এবং অন্যান্য মহান গুণাবলী তাদের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
দুনিয়াবী লেনদেনের বিষয়াদিতে আপনি তাদেরকে দেখতে পাবেন যে, তারা সততার সাথে সকল প্রকার লেন-দেন সম্পন্ন করে থাকেন। কাউকে ধোকা দেন না। ক্রয়-বিক্রয়ের সময় তারা দ্রব্যের আসল অবস্থা বর্ণনা করে দেন। এদিকে ইঙ্গিত করেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُورِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا»
“পৃথক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই ক্রয়-বিক্রয় বাতিল করার অধিকার রয়েছে। যদি তারা উভয়েই সত্য বলে এবং দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে, আল্লাহ তাদের বেচা-কেনায় বরকত দান করেন। আর যদি মিথ্যা বলে এবং দোষ-ত্রুটি গোপন করে, তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের ভিতর থেকে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হয়”।[2]
উপরে যে সমস্ত গুণাবলীর আলোচনা করা হলো, কোনো ব্যক্তির মাঝে উক্ত গুণাবলীর কোনো বৈশিষ্ট্য অবর্তমান থাকলে এ কথা বলা যাবে না যে, সে নাজাত প্রাপ্ত দল হতে বের হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই আপন আপন আমল অনুযায়ী মর্যাদা লাভ করবে। তবে তাওহীদের ক্ষেত্রে ত্রুটি করলে নাজাত প্রাপ্ত দল হতে বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদ‘আতের বিষয়টিও অনুরূপ। কিছু কিছু বিদ‘আত এমন আছে, যা মানুষকে নাজাতপ্রাপ্ত দল থেকে বের করে দেয়। তবে চরিত্র ও লেন-দেনের ভিতরে কেউ ত্রুটি করলে সে নাজাত প্রাপ্ত দল থেকে বের হবে না, বরং মর্যাদা কমিয়ে দিবে।
সম্ভবত আখলাকের বিষয়টি একটু দীর্ঘ করে বর্ণনা করা দরকার। চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরস্পরে একতাবদ্ধ থাকা যায় এবং আল্লাহ তা‘আলা যে হকের ওপর ঐক্যবদ্ধ থাকার আদেশ দিয়েছেন, তার ওপর অটুট থাকা বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحٗا وَٱلَّذِيٓ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ وَمَا وَصَّيۡنَا بِهِۦٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰٓۖ أَنۡ أَقِيمُواْ ٱلدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُواْ فِيهِۚ﴾ [الشورى: ١٣]
“তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন এমন দীনকে, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে। আর যা আমরা অহী করেছিলাম তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে মতভেদ করো না।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১৩] আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়েছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ فَرَّقُواْ دِينَهُمۡ وَكَانُواْ شِيَعٗا لَّسۡتَ مِنۡهُمۡ فِي شَيۡءٍۚ﴾ [الانعام: ١٥٩]
“নিশ্চয় যারা দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে আপনি কোনো ব্যাপারেই তাদের অন্তর্ভুক্ত নন।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৫৯]
সুতরাং ঐক্যবদ্ধ থাকা নাজী ফিরকার (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের) অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাদের মাঝে কোনো ইজতেহাদী বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে তাদের এ মতবিরোধ পরস্পরের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ এবং শত্রুতার সৃষ্টি করে না; বরং তারা বিশ্বাস করে যে, তারা পরস্পরে ভাই। যদিও তাদের মাঝে এ মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি তাদের একজন এমন ইমামের পিছনেও সালাত আদায় করে থাকে, তার দৃষ্টিতে সেই ইমাম অযু বিহীন। আর ইমাম বিশ্বাস করে যে, সে অযু অবস্থায় রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা উটের গোশত খেয়ে অযু করে নি এমন ইমামের পিছনেও সালাত আদায় করে থাকে। ইমাম মনে করে যে, উটের গোশত খেলে অযু ভঙ্গ হয় না। আর মুক্তাদী মনে করে যে, অযু ভঙ্গ হয়ে যায়। তা সত্বেও সে মনে করে উক্ত ইমামের পিছনে সালাত আদায় করা জায়েয আছে।
এমনটি তারা এ জন্যই করে যে, যেখানে ইজতেহাদের সুযোগ রয়েছে সেখানে ইজতেহাদের কারণে যে সকল মতভেদ সৃষ্টি হয়, তা প্রকৃতপক্ষে মতভেদ নয়। কেননা প্রত্যেকেই আপন আপন দলীলের অনুসরণ করে থাকে, যে সব দলীলের অনুসরণ করা তিনি আবশ্যক মনে করে থাকেন এবং যে দলীল থেকে বিমুখ হওয়া তিনি জায়েয মনে করেন না। তারা মনে করেন তাদের কোনো দীনি ভাই দলীলের অনুসরণ করতে গিয়ে যদি কোনো আমলে তাদের বিরোধিতা করেন প্রকৃতপক্ষে তারা বিরোধিতা করেন নি; বরং তাদের অনুরূপই করেছেন। কারণ, তারাও দলীলের অনুসরণ করার প্রতি আহ্বান জানান। যেখানেই তা পাওয়া যাক না কেন। সুতরাং তিনি যদি তার কাছে থাকা কোনো দলীল অনুযায়ী আমল করার কারণে তাদের বিরোধিতাও করেন তবুন তিনি প্রকৃতপক্ষে তাদের সাথে একাত্মতাই পোষণ করলেন। কেননা তিনি তো সে পথেই চললেন যে পথের দিকে তারা আহ্বান করে এবং পথনির্দেশ করে, আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করা।
অধিকাংশ আলিমের কাছে এ বিষয়টি অস্পষ্ট নয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে সাহাবীগণের ভিতরে এরকম অনেক বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। তিনি কাউকে ধমক দেন নি বা কারও ওপর কঠোরতা আরোপ করেন নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খন্দকের যুদ্ধ হতে ফেরত আসলেন, তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী বানু কুরায়যায় অভিযান পরিচালনার প্রতি ইঙ্গিত করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে বললেন, তোমাদের কেউ যেন বানু কুরায়যায় না গিয়ে আসরের সালাত না পড়ে।[3]
সাহাবীগণ এ কথা শুনে মদীনা হতে বের হয়ে বানু কুরায়যার দিকে রওনা দিলেন। পথিমধ্যে আসরের সালাতের সময় হয়ে গেল। তাদের কেউ সালাত না পড়েই বানু কুরায়যায় পৌঁছে গেলেন। এদিকে সালাতের সময় শেষ হয়ে গেল। তারা বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আসরের সালাত অবশ্যই বানী কুরায়যায় গিয়ে পড়তে হবে। তাদের কেউ সালাত ঠিক সময়েই পড়ে নিল। তাদের কথা হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বের হতে বলেছেন। তাঁর কথার অর্থ এটা নয় যে, আমরা সময় মত সালাত না পড়ে পিছিয়ে নিব। এরাই সঠিক ছিল। তদুপরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’দলের কাউকে ধমক দেন নি। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য বুঝার ক্ষেত্রে ভিন্নমত হওয়া সত্বেও তাদের মাঝে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় নি।
এ হাদীসটি বুঝতে গিয়ে যে মতভেদের সূচনা হয়েছিল, তার কারণে তাদের মধ্যে শত্রুতা বা দলাদলির সৃষ্টি হয় নি। আর সেজন্য আমি মনে করি দলীলের ভিত্তিতে ইজতেহাদী কোনো মাসআলায় মতভেদ হওয়া সত্বেও, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিৎ। তাদের মধ্যে দলাদলি থাকবে না। এমন হবে না যে তাদের একদল অমুকের দিকে সম্পর্কযুক্ত, দ্বিতীয়দল অন্যের দিকে সম্পর্কযুক্ত হবে আর তৃতীয়দল অন্যের দিকে নিজেকে সম্পর্কযুক্ত করবে, পরস্পর হানাহানিতে, বাকযুদ্ধে লিপ্ত হবে, পরস্পর শত্রুতা পোষণ করবে, হিংসা-বিদ্বেষ করবে এমনসব বিষয়ে যেখানে ইজতিহাদ করা গ্রহণযোগ্য। এখানে আমি বিভিন্ন গোষ্ঠীকে বিশেষ করে নাম ধরে বলার দরকার মনে করছি না, কিন্তু বিবেকবান মাত্রই সহজে বুঝতে পারবে এবং তার তার জন্য তা স্পষ্ট হবে।
সুতরাং আমার মত হচ্ছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ওপর কর্তব্য হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ থাকা, এমনকি যদিও কোনো বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের ভাষ্য বুঝার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মতভেদ হয়েও যায়। কারণ আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা এটি এমন এক বিষয়, যাতে ব্যাপক উদারতা রয়েছে। সুতরাং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রুরা চায় যে, মুসলিমগণ পরস্পরে বিভক্ত হোক। তাদের কারও শত্রুতা প্রকাশিত, আবার তাদের কেউ কেউ ইসলাম ও মুসলিমদের বন্ধুত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকে, অথচ তারা প্রকৃতই শত্রু। সুতরাং আমাদের ওপর কতর্ব্য হবে ‘নাজী ফির্কা’ তথা নাজাতপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে হকের ওপর ঐক্যবদ্ধ থাকা।
>
[1] সকল প্রকার ইবাদাত এককভাবে আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করাকে তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বলা হয়। আল্লাহর সৃষ্টি, রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও পরিচালনায় আল্লাহকে একক হিসাবে বিশ্বাস করার নাম তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহ। আর কুরআন ও সুন্নায় আল্লাহর যে সমস্ত নাম ও গুণাবলীর বর্ণনা রয়েছে, সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস করাকে তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত বলা হয়।
[2] সহীহ বুখারী ও মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল বুয়ূ‘ (ক্রয়-বিক্রয়)।
[3] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল খাওফ।