এক রাকাত বিতর সালাত বা নামাজের দলিল , ব্যাখ্যা ও দলিল বা রেফারেন্স সহ
বিতরের সালাতঃ বিতর অর্থ হল বেজোর।
রাতের সালাত দুই দুই রাকাত করে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ফজর হওয়ার আশংকা করে তবে সে যেন ‘এক রাকাত’ সালাত আদায় করে নেয়। আর সে যে সালাত আদায় করলো তা তার জন্য বিতর (বেজোর) হয়ে যাবে। [সহিহ বুখারীর ইফাঃ ৯৩৭–৯৪০, আধুঃ ৯৩২—৯৩৫]
১-প্রশ্ন: বিতরের সালাত কত রাকআত?
উত্তর : বিতরের সালাতের সর্বনিম্ন সংখ্যা হল এক রাক‘আত এবং সর্বোচ্চ হল ১১ রাকআত।
বিতরের সালাত ১ রাকআত পড়াও জায়েয আছে। আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : কেউ যদি ১ রাকআত বিতর পড়তে চায়, তা সে করতে পারে। যে ব্যক্তি বিতরের সালাত ৩ রাকআত পড়তে চায়, তা সে পড়তে পারে।’’ কেউ ৫ রাকআত বিতর পড়তে চাইলে তা সে পড়তে পারে।’’ (আবূ দাউদ : ১৪২২; নাসাঈ : ১৭১২)
এভাবে ৭ বা ৯ বা ১১ রাকআত পর্যন্ত বিতরের সালাত আদায় করার সুযোগ বা জায়েয আছে।
২-প্রশ্ন : বিতরের সালাতে কি একবার নাকি দু’বার সালাম ফিরাব?
উত্তর : দু’টাই করা জায়েয আছে।
(ক) এক সালামে বিতর পড়ার দলীল :
মিসওয়ার বিন মাখরামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাতের বেলা আমরা আবূ বাকার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে দাফন করলাম। অতপর উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘আমি বিতর পড়িনি। এই বলে তিনি দাঁড়ালেন আর আমার তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে গেলাম। এরপর তিনি আমাদের নিয়ে ৩ রাকআত বিতর পড়তেন। শেষ রাকআতের আগে তিনি সালাম ফিরাতেন না (এক সালামে তিন রাকাত বিতর পড়তেন)। (ত্বহাবী : ১৭৪২)
(খ) দু’ সালামে বিতর পড়ার দলীল :
আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু (বিতরে সালাত) প্রথম দুই রাকআত শেষ করে সালাম ফিরাতেন এবং পরে শেষ (তৃতীয়) রাকআতে আবার সালাম ফিরাতেন। প্রথম দুই রাকআতের সালাম ফিরানের পর প্রয়োজনে কোন কাজের নির্দেশও দিতেন। (বুখারী : ৯২১)
আয়েশা সিদ্দিকা (রা) বলেছেন: রাসূল (স) তিন রাকাত বিতরের সালাত আদায় করতেন। দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক করতেন না, শেষ রাকাতে বৈঠক করতেন। (হাকেম:১১৪০)
দ্বিতীয় পদ্ধতি: অন্নান্য সালাতের মত প্রথমে দুই রাকাত পড়ে নিবেন। তাঁরপর পৃথকভাবে এক রাকাত পড়বেন এবং রুকুর আগে বা পরে দুয়া কুনুত পড়ে সিজদা শেষে বসে সালাম ফিরাবেন। (মুসলিম: ১২৫২)
৩-প্রশ্ন: বিতরের সালাতের আগেই জামাত ছেড়ে যাওয়া কি জায়েয?
উত্তর : ইমাম বিতর শেষ না করা পর্যন্ত জামাআত ছেড়ে চলে যাওয়া ঠিক নয়। কারণ বিতর দ্বারা পুরো রাত্রি জাগরণের অর্থাৎ কিয়ামুল্লাইলের পূর্ণ সওয়াব অর্জিত হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ইমাম নামায শেষ না করা পর্যন্ত যে ব্যক্তি ইমামের সাথে (জামাআতে) তারাবীহ পড়ল তার জন্য পূর্ণ রাত নফল পড়ার সাওয়াব লেখা হয়ে গেল। (তিরমিযী : ৮০৬)
৪-প্রশ্ন: বিতরের সালাত কি মাগরিবের ৩ রাকাতের নিয়মে পড়তে হবে?
উত্তর : না । এরূপ করার কোন সহি হাদিস নেই।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, রাতের বিতর তিন রাকাত উহা দিনের বিতর মাগরিবের মত। এই হাদিস যইফ-দারাকুত্নী হাদিসটি বর্ননা করেন এবং যইফ সাব্যস্ত করেন। ইবনু ওমর (রাঃ) এর বরাতে, ” মাগরিব হচ্ছে দিনের বিতর। তোমরা রাতের নামাজকে বিতর কর। ” তাবারানী উক্ত হাদিস বর্ননা করেন।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্নিত, রাসুল (সাঃ) বলেন,
‘তোমরা মাগরিবের সালাতের সাথে সাদৃশ্য করে তিন রাকাত বিতর পড় না, বরং পাঁচ রাকাত দ্বারা, সাত রাকাত দ্বারা বা নয় রাকাত দ্বারা কিংবা এগার রাকাত দ্বারা বিতর পড়।’দারাকুত্নী উক্ত হাদিস বর্ননা করেন, হাদিস সহিহ।
বিতর হচ্ছে শেষ রাতে এক রাকাত সালাত। – বুখারী, মুসলিম।
‘… যে এক রাকাত বিতর পড়তে চায় সে এক রাকাত পড়তে পারে।’ – আবু দাউদ।
১ রাকাত বিতর সালাতের নিয়মঃ
বিতরের নিয়ত নিয়ে সালাতে দাড়িয়ে সাধারণ সালাতের মতই সানা, আউজুবিল্লাহ বিসমিল্লাহ ইত্যাদি পাঠ করে সুরা ফাতেহা পাঠ করতে হবে সাথে অন্য একটি সুরা বা আয়াত কেরাত হিসেবে পাঠ করতে হবে। তার পর রুকুতে যেতে হবে। রুকু থেকে উঠে সামিয়াল্লাহ..রব্বানা লাকাল হামদ …. ইত্যাদি পাঠ শেষ করে মুনাজাতের মত ২ হাত তুলে ”দুয়া কুনুত” পাঠ করতে হয়। আবার রুকুর আগেও সূরা মিলানোর পর মুনাজাতের মত ২ হাত তুলে দোয়া কুনুত পাঠ করা যায়। উভয়টাই জায়েজ। দুয়া কুনুত পাঠ অপরিহার্য (ওয়াজিব) নয়। তাই না জানলেও বিতর হয়ে যাবে, তবে শিখে নেওয়া উচিত। কুনুত পাঠ করে তারপর সিজদায় গিয়ে দুটো সিজদা করে তাশাহুদে বসে পড়তে হবে। তার পর আত্যাহিয়াতু, দুরুদ, দুয়া মাসুরা ইত্যাদি পাঠ করে সালাম ফেরাতে হবে।
এটাই ১ রাকাত বিতর। সাধারণ সালাতের মতই।
“বিতির” শব্দের অর্থ কি?
বিতির শব্দের অর্থ হলো বেজোড়। আর বেজোড় সংখ্যা হলো ১, ৩, ৫, ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিতির সালাত হিসেবে ১ রাকাত, ৩ রাকাত, ৫ রাকাত, ৭ রাকাত, এমনকি নয় রাকাতও পড়েছেন।
বিতির পড়া কি ফরয/ওয়াজিব না সুন্নতঃ
যদিও আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ বিতির সালাতকে ওয়াজিব মনে করে কিন্তু আসলে বিতির সালাত হলো সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
দলীলঃ ১ – আলী (রাঃ) বলেন, “বিতির সালাত ফরয সালাতের মতো বাধ্যতামূলক নয়, তবে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) একে সুন্নত করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ বেজোড় (বিতির), তিনি বেজোড় সংখ্যা পছন্দ করেন। সুতরাং, হে আহলে কুরআন! তোমরা বিতির পড়তে থাকো।”
আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ।
দলীলঃ ২ – আবু মুহাম্মাদ নামে এক লোক বললো, বিতির সালাত ওয়াজিব। এই কথা শুনে প্রখ্যাত সাহাবী উবাদাহ বিন সামিত (রাঃ) বলেন, আবু মুহাম্মাদ ভুল বলেছে।……হাদীসের শেষ পর্যন্ত।
আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে হিব্বান।
দলীলঃ ৩ – রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ফরয সালাত কখনোই সওয়ারীর (গাধা বা ঘোড়ার) পিঠে চড়ে পড়তেন না, শুধু নফল সালাত পড়তেন। কিন্তু তিনি বিতির সালাত সওয়ারীর উপর পড়েছেন। এ থেকে প্রমানিত হয় বিতির সালাত ফরয বা ওয়াজিব নয়।
বুখারী, মুসলিম, দারা কুতনী ১৬১৭।
বিতির পড়ার সওয়াব কতটুকুঃ
বিতির নামায লাল রংয়ের উটের চাইতে বেশি মূল্যবান।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“আল্লাহ একটি নামায দান করে তোমাদেরকে বিশেষ সুযোগ করে দিয়েছেন যা তোমাদের জন্য লাল রংয়ের উটের চাইতে উত্তম। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেটা কোন নামায? তিনি বললেন, ‘বিতির নামায’ যা পড়া হয় ইশা নামাযের পর থেকে ফযর উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।”
আবু দাউদঃ ১৪১৮, তিরমিযীঃ ৪৫২, ইবনে মাজাহ, দারেমী, হাদীসটি সহীহ।
* বর্তমান যুগে যেমন দামি গাড়ি মার্সিডিস বেঞ্চ বা ফেরারী ঠিক তেমনি, তখনকার যুগে লাল রংয়ের উটের দাম অনেক বেশি ছিলো।
কখন পড়তে হবে?
ইশার পর থেকে ফযরের আগে পর্যন্ত পড়া যাবে। তবে রাতের সর্বশেষ সালাত হিসেবে বিতির পড়তে হবে। বিতির রাতের শেষ অংশে পড়া বেশি সওয়াব, তবে নিয়মিত উঠার অভ্যাস না থাকলে বা শেষ রাত্রে উঠার নিশ্চয়তা না থাকলে ঘুমানোর আগেই পড়ে ফেলতে হবে।
বিতির সালাত কাযা পড়া যাবেঃ
বিতির ফযরের আগে পড়তে না পারলে ফযরের পরে বা সকাল বেলায় সুযোগ মতো পড়া যাবে। এনিয়ে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এমনকি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজে সকাল বেলা বিতির কাযা পড়েছেন (তাবারানী)।
বিতির সালাত কত রাকাতঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কয়েকভাবে বিতির পড়েছেন। তিনি বিতির ১ রাকাত, ৩ রাকাত, ৫ রাকাত, ৭ রাকাত, ৯ রাকাত পড়েছেন। এইসবগুলোই সুন্নত। কারো ইচ্ছা হলে সে এর যেকোনো একটা পড়তে পারে। তবে নিচে শুধুমাত্র ১ আর ৩ রাকাত বিতির পড়ার নিয়ম বর্ণনা করা হলো।
কুনুত পড়া কি ওয়াজিব?
কুনুত পড়া ওয়াজিব নয়। কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সব সময় বিতির সালাতে কুনুত পরতেন না। তাই আমাদের উচিত বিতির সালাতে কখনো কখনো দুয়া কুনুত ছেড়ে দেওয়া, কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নত এমনই।
আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী, মিশকাত ১২৯১-১২৯২।
৩ রাকাত বিতিরের নিয়মঃ
বিতির ৩ রাকাত দুইভাবে পড়া যায়, এক সালামে অথবা দুই সালামে।
এক সালামে পড়লে, আপনি সাধারণ সালাতের মতো দুই রাকাত পড়বেন কিন্তু দুই রাকাতের যে বৈঠক সেখানে বসবেন না। কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা বিতিরকে মাগরিবের মতো করে দিওনা”. এখন দুই রাকাতের বৈঠকে না বসে আপনি ৩ রাকাত বিতিরকে মাগরিবের সালাতের সাথে পার্থক্য সৃষ্টি করে দিলেন। ২য় রাকাতে বৈঠকে না বসে দাঁড়িয়ে ৩য় রাকাত পুরো করবেন, আর ৩য় রাকাতে আপনি ১ রাকাত বিতির পড়ার যে নিয়ম সেইভাবে কুনুত পড়বেন। এর পরে রাকাত পুরো করে সালাম ফিরাবেন।
বিতির সালাতের এই নিয়মটা আজ পর্যন্ত মক্কা ও মদীনাতে অনুসরণ করা হয় –
আর দুই সালামে পড়তে চাইলে, প্রথম দু রাকাত সাধারণ নফল সালাতের মতো পড়বেন, বৈঠক করে সালাম ফিরাবেন। এর পরে ১ রাকাত বিতিরের যে নিয়ম বর্ণনা করা হলো ঠিক সেইভাবেই ১ রাকাত পড়বেন, এই হলো ২+১=৩ রাকাত বিতির।
উল্লেখ্য – কারো অতিরিক্ত নফল সালাত পড়ার ইচ্ছা থাকলে সে ২ রাকাতের পর আরো দুই রাকাত পড়বে, এইভাবে ২ রাকাত রাকাত পড়ে শেষে ১ রাকাত দিয়ে সবগুলোকে বেজোড়ে (বিতিরে) পরিণত করবে।