আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নন , তিনি আরশে আছেন , ব্যাখ্যা ও দলিল বা রেফারেন্স সহ
প্রথমে আসুন দেখে নেওয়া যাক কিছু কোরআনের আয়াত এবং তাফসীর ইবনে কাছীর হতে দলীলসমূহঃ
১. নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশ সমূহ এবং পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন । (সুরা আরাফ: ৫৪)
তাফসীরঃ ইমাম ইবন কাসীর বলেছেনঃ “আসমান ও জমিনকে আল্লাহ ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, এই ছয় দিনের ব্যস্ততার পর আল্লাহ তা’আলা আরশের উপর সমাসীন হন। আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন এ স্থানে লোকেরা বহু মতামত পেশ করেছেন বহু জল্পনা-কল্পনা করেছেন। এগুলর ব্যাখ্যা দেওয়ার সুজোগ এখানে নেই। এ ব্যাপারে আমরা শুধু মাত্র পূর্ববর্তী সহীহ আমলকারী বিজ্ঞজনদের মতামত অবলম্বন করেছি। তারা হচ্ছেন ইমাম মালিক, আওযায়ী, সাউরী,লায়েস ইবন সাদ, শাফিঈ, আহমাদ ইবন হাম্বল, ইসহাক ইবন রাহওয়াহ এবং ইসলামের নবীন ও প্রবীন গ্রহণযোগ্য মুসলিম ইমামগন। আর তাদের মতামত হচ্ছে এই যে, কোন রকম সাদৃশ্য স্থাপন ছাড়াই এইটার(আল্লাহ আরশে সমাসীন এইটার) উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। মোট কথা যা কিছু আল্লাহ তা’আলা বলেছেন ওইটাকে কোন খেয়াল ও সন্দেহ ছাড়াই মেনে নিতে হবে এবং কোন চুল-চেরা বিশ্লেষণ করা চলবে না” [1]
অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন তিনি আরশে সুতরাং কোন প্রকার বিশ্লেষণ ছাড়াই মেনে নিতে হবে যে আল্লাহ আরশে সমাসীন এবং আল্লাহ আরশে সমাসীন এইটার কোন সাদৃশ্য ও কল্পনা করা যাবে না কেননা কোন কিছুই তার মত নয়।
২. রহমান (আল্লাহ্) আরশে সমুন্নত (সূরা ত্ব-হা: ৫)
৩. তেমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছো যে, যিনি আকাশে অবস্থিত রয়েছেন তিনি তোমাদেরকে ভূগর্ভে বিলীন করে দিবেন না। (সুরা মূলক:১৬)
৪. বরং আল্লাহ তাকে তাঁর নিকটে উত্তলন করে নিয়েছেন। (সূরা নিসাঃ ১৫৮)
৬. নিশ্চয় আল্লাহই হচ্ছেন তোমাদের প্রতিপালক, যিনি আকাশ সমূহ এবং পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন। (সুরা ইয়উনুসঃ ৩)
তাফসীরঃ ইমাম ইবন কাসীর বলেনঃ “অতপর আল্লাহ তা’আলা বড় আরশের উপর সমাসীন হয়ে গেলেন। আরশ হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টি বস্তুর মধ্যে সবচেয়ে বড় সৃষ্টবস্তু” [2]
৭. তিনি আকাশমণ্ডলী,পৃথিবীকে এবং এগুলোর মধ্যবর্তী সমস্ত কিছু ছয় দিবসে সৃষ্টি করেন: অতপর তিনি আরশে সমাসীন হন: তিনি রহমান, তার সম্মন্ধে যে অবগত আছে তাকে জিজ্ঞেস করে দেখো। (সুরা ফুরকানঃ ৫৯)
তাফসীরঃ ইমাম ইবন কাসীর বলেছেনঃ “তিনি সবকিছুর সৃষ্টি কর্তা ও অধিপতি। তিনি স্বীয় ক্ষমতাবলে আসমান যমীনের মত বিরাট মাখলুককে মাত্র ৬ দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। কার্যাবলী তদবীরের মাধ্যমে হয়ে থাকে” [3]
এখন আসুন সহীহ হাদীস হতে কিছু দলীল দেখা যাকঃ
১. তোমরা কি আমাকে আমানতদার মনে কর না, অথচ যিনি আসমানে আছেন আমি তাঁর আমানতদার। আমার কাছে আসমানের খবর সকাল- সন্ধ্যায় আসে।[4]
২. মুয়াবিয়া ইবন হাকাম আস-সুলামী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনৈক দাসীকে প্রশ্ন করেছিলেনঃ ‘আল্লাহ কোথায়’ উত্তরে সে বলেছিলঃ আল্লাহ আসমানে। তিনি বললেন, আমি কে? সে বললঃ আপনি আল্লাহ রাসূল। তখন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার মনিবকে বললেন তাকে আজাদ করে দেয়। কেননা সে ঈমানদার। [5]
৩. রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যারা যমিনে আছে তোমরা তাদের প্রতি দয়াশীল হও যিনি আকাশে আছেন তিনি তমাদের প্রতি দয়াশীল হবেন’। [6]
৪. রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন) বলেছেন, “প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছ যে আমাকে ডাকবে আর আমি তার ডাকে সাড়া দিব? কে আছ যে আমার কাছে কিছু চাইবে আর আমি তাকে তা দান করব। কে আছ যে আমার কাছে ক্ষমা চাবে আর আমি তাকে ক্ষমা করে দিব”। [7]
এখন আসুন সালাফে সালেহীন এবং ইমাম ও মুজতাহীদ এর বানী হতে কিছু দলীল দেখা যাকঃ
১. আমীরুল মুমিনীন আবু বকর সিদ্দিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছনেঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আসমানের উপর জীবিত আছেন, কখনোই মৃত্যুমুখে পতিত হবেন না। [8]
২. ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ যে বলবে যে, আল্লাহ আসমানে আছেন না যমিনে আছেন,তা আমি জানি না, সে কুফরী করবে, কেননা আল্লাহ বলেন- রহমান আরশে সমাসীন। আর তার আরশ শপ্ত আকাশের উপর। [9]
৩. ইমাম আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আমরা এবং তাবেয়ীগন বলেন যে, অবশ্যই আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি তার আরশের উপর, এবং তার গুন(সিফাত) সম্পর্কে যা সুন্নাহ এ বর্ণিত হয়েছে তা আমরা বিশ্বাস করি। [10]
৪. ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আল্লাহ আরশের উপর আর তার জ্ঞানের পরিধি সর্বব্যাপী বিস্তৃত। [11]
৫. ইমাম শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আমি যে তরিকার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যাদেরকে ঐ তরিকার উপর পেয়েছি সুফিয়ান সাওরী,মালিক প্রমখগন তা হল এই কথার স্বীকৃতি দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন হক মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র রাসুল আর আল্লাহ তিনি আসমানে আরশের উপর রয়েছেন। তিনি তার বান্দার নিকটবর্তী হন যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেন এবং যে ভাবে চান ঠিক সে ভাবেই দুনিয়ার আকাশে অবতরন করেন। [12]
৬. ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) এর পুত্র ইমাম আব্দুল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আমার বাবাকে (ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল) জিজ্ঞাসা করা হল যে, আল্লাহ তার সৃষ্টি থেকে দূরে সপ্তম আকাশের উপরে তার আরশে সমাসীন। তাঁর ক্ষমতা ও জ্ঞানের পরিধি সর্বত্র বিস্তৃত। এর উত্তরে তিনি(ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল) বলেছেনঃ হ্যাঁ, তিনি(আল্লাহ) আরশের উপর সমাসীন এবং তার জ্ঞানের বহির্ভূত কিছুই নেই। [13]
৭. ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ উলামাদের(আলেমদের) ইজমা এই যে, আল্লাহ আরশের উপর। [14]
৮. উসমান ইবন সাঈদ আল-দারিমী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ এবং মুসলিমগণ একমত পোষণ করেছেন যে আল্লাহ তার আরশের উপর। [15]
৯. ইমাম আলী ইবন আল-মাদিনী (রাহিমাহুল্লাহ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাহ এর আকীদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন, তিনি জবাবে বলেছিলেনঃ তারা(আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাহ) বিশ্বাস করে যে আল্লাহ জান্নাতের উপর, তার আরশের উপর। [16]
১০. ইমাম ইবন খুযাইমা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি স্বীকার করে না যে আল্লাহ্ তাআলা সপ্তাকাশে স্বীয় আরশে সমুন্নত, সৃষ্টি জগত হতে সম্পূর্ণ আলাদা- সে কাফের। তাকে তওবা করার নির্দেশ দিতে হবে। তওবা না করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। অতঃপর তার লাশ ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতে হবে যাতে করে কিবলা ওয়ালা মুসলমানগণ এবং কর প্রদানকারী অমুসলিমগণ তার দূর্গন্ধে কষ্ট না পায়। [17]
১১. শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আল্লাহ আরশে সমুন্নত রয়েছেন। রাজত্ব নিজ আয়ত্তে রেখেছেন। সমস্ত বস্তুকে বেষ্টন করে রেখেছেন। আর এভাবে তার পরিচয় দেওয়া জায়েজ নয় যে, তিনি প্রত্যেক স্থানে বিরাজমান: বরং বলতে হবে তিনি আসমানে আরশের উপর রয়েছেন যেমনটি তিনি(নিজেই) বলেছেনঃ ‘রহমান আরশে সমুন্নত’।
স্বাভাবিক ভাবেই এইকথা বলতে হবে, কোন প্রকার অপব্যাখ্যা করে নয়। তিনি যে আসমানে আছেন একথা নবী-রাসুলদের প্রতি নাজিলকৃত প্রত্যেক কিতাবেই লিখিত আছে। তবে আরশে তিনি কিভাবে রয়েছেন তার পদ্ধতি কারো জানা নেই।[18]
১২. ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ আমি তাদের(জাহমিয়া) জিজ্ঞাসা করলামঃ তোমরা প্রত্যাখ্যান করো আল্লাহর আরশে থাকাকে। তাহলে কেন আল্লাহ বলেছেনঃ ‘দয়াময় আল্লাহ আরশে সমাসীন হয়েছেন’? (সুরা ত্বহাঃ ৫)
তারা বললঃ ‘তিনি আরশের উপরও আছেন, ৭ আসমানের উপরেও আছেন, ৭ আসমানের নিচেও আছেন এবং তিনি এই পৃথিবীতেও আছেন’
আমি(ইমাম আহমাদ) জবাব দিলামঃ “ মুসলিমরা জানে অনেক জায়গায় আল্লাহ থাকা তাঁর মহিমার বিরুদ্ধে, যেমন তোমাদের শরীর, তোমাদের পেটে থাকা, টয়লেটে থাকা , পতিতালয়ে থাকা , এইরূপ জায়গায় থাকা আল্লাহর মহান মর্যাদার বিরুদ্ধে। এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের জানিয়েছেন তিনি আকাশে আছেন এই আয়াত গুলোর মাধ্যমে”। [19]
এখন আসুন দলিল বা প্রমাণ সহ আরো বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাকঃ
প্রথমে আমরা কুরআনের কিছু আয়াত সম্পর্কে বিস্তারিত তাফসির থেকে জেনে নিইঃ
আয়াত ৬ঃ৩ এর অনুবাদ ও তাফসির নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। আর আসমানসমূহ ও যমীনে তিনিই আল্লাহ, তিনি জানেন তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য এবং জানেন যা তোমরা অর্জন কর। আল-বায়ান
২। আসমানসমূহ আর যমীনে তিনিই আল্লাহ, তোমাদের গোপন বিষয়াদি আর তোমাদের প্রকাশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে তিনি জানেন, আর তিনি জানেন যা তোমরা উপার্জন কর। তাইসিরুল
৩। আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে ঐ এক আল্লাহই রয়েছেন, তোমাদের অপ্রকাশ্য ও প্রকাশ্য সব অবস্থাই তিনি জানেন, আর তোমরা যা কিছু কর তাও তিনি পূর্ণরূপে অবগত আছেন। মুজিবুর রহমান
৪। And He is Allah, [the only deity] in the heavens and the earth. He knows your secret and what you make public, and He knows that which you earn. Sahih International
এখন আসুন, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ থেকে আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা দেখা যাকঃ
১। তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আয়াতঃ আকাশ ও পৃথিবীর তিনিই আল্লাহ। তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছু তিনি জানেন এবং তোমরা যা কর, তাও তিনি অবগত আছেন। (১)
(১) আহলে সুন্নাহ অর্থাৎ, সালাফদের আকীদা হলো, মহান আল্লাহ তো আরশে সমাসীন; যেভাবে তাঁর সত্তার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু তাঁর জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান। অর্থাৎ, কোন জিনিসই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। অবশ্য কোন কোন ভ্রান্ত দল আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়াকে মানে না। তারা বলে যে, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান এবং তারা এই আয়াতের ভিত্তিতেই তাদের (ভ্রান্ত) আকীদা সাব্যস্ত করে। অথচ তাদের আকীদা যেমন ভুল, অনুরূপ তাদের দলীলও সঠিক নয়। কেননা, আয়াতের অর্থ হলো, যে সত্তাকে আসমান ও যমীনে ‘আল্লাহ’ বলে ডাকা হয়, আসমানে ও যমীনে যার রাজত্ব বিস্তৃত এবং আসমান ও যমীনে যাকে সত্য উপাস্য মনে করা হয়, সেই আল্লাহই তোমাদের গোপনীয় ও প্রকাশ্য সমস্ত আমলাদির খবর রাখেন। (ফাতহুল ক্বাদীর) এর আরো ব্যাখা করা হয়েছে, উলামাগণ তা তফসীরের কিতাবগুলোতে দেখতে পারেন। যেমন, তাফসীরে ত্বাবারী, ইবনে কাসীর ইত্যাদি।
২। তাফসীরে জাকারিয়া
আয়াতঃ আর আসমানসমূহ ও যমীনে তিনিই আল্লাহ(১), তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু তিনি জানেন এবং তোমরা যা অর্জন কর তাও তিনি জানেন।(২)
(১) এ আয়াতের অনুবাদে কোন প্রকার ভুল বুঝার অবকাশ নেই। মহান আল্লাহ তার আরশের উপরই রয়েছেন। আসমান ও যমীনের সর্বত্রই তার দৃষ্টি, জ্ঞান ও ক্ষমতা রয়েছে। তিনি সর্বত্রই মা’বুদ। আয়াতের এক অর্থ এটাই। কোন কোন মুফাসসির অর্থ করেছেন, তিনিই আল্লাহ যিনি আসমান ও যমীনের যত গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু জানেন। আবার কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, এখানে আসমান বলে ঊর্ধ্বজগত বোঝানো হয়েছে। সেটা আরশও হতে পারে। সুতরাং আয়াতের অনুবাদ হবে, তিনিই আল্লাহ যিনি আসমানে তথা আরশের উপর রয়েছেন, সেখানে থাকলেও যমীনের যত গোপন ও প্রকাশ্য বিষয়াদি রয়েছে সব কিছু জানেন। [তাবারী, বাগভী, কুরতুবী, ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর]
(২) এ আয়াতে প্রথম দু’আয়াতে বর্ণিত বিষয়বস্তুর ফলাফল বর্ণিত হয়েছে। তা এই যে, আল্লাহ তা’আলাই এমন এক সত্তা, যিনি আসমান ও যমীনে ইবাদাত ও আনুগত্যের যোগ্য এবং তিনিই তোমাদের প্রতিটি প্রকাশ্য ও গোপন অবস্থা এবং প্রতিটি উক্তি ও কর্ম সম্পর্কে পুরোপুরি পরিজ্ঞাত। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারও ইবাদাত করো না। তিনি যেহেতু তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবই জানেন সুতরাং তার নাফরমানী করা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করো এবং এমন কাজ করবে, যা তোমাদেরকে তাঁর নৈকট্য প্রদান করবে, তাঁর রহমতের অধিকারী করবে। এমন কোন কাজ করো না, যাতে তার নৈকট্য থেকে দূরে সরে যাও। [সা’দী]
আয়াত ৭ঃ৫৪ এর অনুবাদ ও তাফসির নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে উঠেছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। প্রত্যেকটি একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজী, যা তাঁর নির্দেশে নিয়োজিত। জেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই। আল্লাহ মহান, যিনি সকল সৃষ্টির রব। আল-বায়ান
২। তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি ছয় দিনে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন। দিনকে তিনি রাতের পর্দা দিয়ে ঢেকে দেন, তারা একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে এবং সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি তাঁরই আজ্ঞাবহ। জেনে রেখ, সৃষ্টি তাঁর, হুকুমও (চলবে) তাঁর, বরকতময় আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতিপালক। তাইসিরুল
৩। নিশ্চয়ই তোমাদের রাব্ব হচ্ছেন সেই আল্লাহ যিনি আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি স্বীয় আরশের উপর সমাসীন হন। তিনি দিনকে রাত দ্বারা আচ্ছাদিত করেন যাতে ওরা একে অন্যকে অনুসরণ করে চলে ত্বরিত গতিতে; সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্ররাজী সবই তাঁর হুকুমের অনুগত। জেনে রেখ, সৃষ্টির একমাত্র কর্তা তিনিই, আর হুকুমের একমাত্র মালিকও তিনি, সারা জাহানের রাব্ব আল্লাহ হলেন বারাকাতময়। মুজিবুর রহমান
৪। Indeed, your Lord is Allah, who created the heavens and earth in six days and then established Himself above the Throne. He covers the night with the day, [another night] chasing it rapidly; and [He created] the sun, the moon, and the stars, subjected by His command. Unquestionably, His is the creation and the command; blessed is Allah, Lord of the worlds. Sahih International
এখন আসুন, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ থেকে আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা দেখা যাকঃ
তাফসীরে জাকারিয়া
আয়াতঃ নিশ্চয় তোমাদের রব আল্লাহ্ যিনি আসমানসমূহ ও যমীন ছয়(১) দিনে(২) সৃষ্টি করেছেন(৩); তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন।(৪) তিনিই দিনকে রাত দিয়ে ঢেকে দেন, তাদের একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে। আর সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্ররাজি, যা তারই হুকুমের অনুগত, তা তিনিই সৃষ্টি করেছেন।(৫) জেনে রাখ, সৃজন ও আদেশ তারই। (৬) সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ কত বরকতময়।
(১) এখানে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি ছয় দিনে সমাপ্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর ব্যাখ্যা দিয়ে সূরা ফুসসিলাতের নবম ও দশম আয়াতে বলা হয়েছে যে, দুদিনে ভূমণ্ডল, দুদিনে ভূমণ্ডলের পাহাড়, সমুদ্র, খনি, বৃক্ষ, উদ্ভিদ এবং মানুষ ও জন্তুজানোয়ারের পানাহারের বস্তু-সামগ্ৰী সৃষ্টি করা হয়েছে। মোট চার দিন হল। বলা হয়েছেঃ (خَلَقَ الْأَرْضَ فِي يَوْمَيْنِ) আবার বলা হয়েছে (وَقَدَّرَ فِيهَا أَقْوَاتَهَا فِي أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ) যে দুদিনে ভূমণ্ডল সৃষ্টি করা হয়েছে, তা ছিল রবিবার ও সোমবার। দ্বিতীয় দুদিন ছিল মঙ্গল ও বুধ, যাতে ভূমণ্ডলের সাজ-সরঞ্জাম পাহাড়, নদী ইত্যাদি সৃষ্টি করা হয়। এরপর বলা হয়েছেঃ (فَقَضَاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ فِي يَوْمَيْنِ) অর্থাৎ “অতঃপর সাত আকাশ সৃষ্টি করেন দুদিনে [সূরা ফুসসিলাতঃ ১২ বাহ্যতঃ এ দুদিন হবে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার; অর্থাৎ এ পর্যন্ত ছয় দিন হল। [আদওয়াউল বায়ান]
(২) জানা কথা যে, সূর্যের পরিক্রমণের ফলে দিন ও রাত্রির সৃষ্টি। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টির পূর্বে যখন চন্দ্ৰ-সূৰ্যই ছিল না, তখন ছয় দিনের সংখ্যা কি হিসাবে নিরূপিত হল? কোন কোন তাফসীরবিদ বলেছেনঃ ছয় দিন বলে জাগতিক ৬ দিন বুঝানো হয়েছে। কিন্তু পরিস্কার ও নির্মল উত্তর এই যে, সূর্যোদয় থেকে সূর্যস্ত পর্যন্ত যে দিন এবং সূর্যস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত যে রাত এটা এ জগতের পরিভাষা। বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ্ তা’আলার কাছে দিবা-রাত্রির পরিচয়ের অন্য কোন লক্ষণ নির্দিষ্ট থাকতে পারে; যেমন জান্নাতের দিবা-রাত্রি সূর্যের পরিক্রমণের অনুগামী হবেনা। সহীহ বর্ণনা অনুযায়ী যে ছয় দিনে জগত সৃষ্টি হয়েছে তা রবিবার থেকে শুরু করে শুক্রবার শেষ হয়।
(৩) এখানে প্রশ্ন হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলা সমগ্র বিশ্বকে মুহুর্তের মধ্যে সৃষ্টি করতে সক্ষম। স্বযং কুরআনুল কারীমেও বিভিন্ন ভঙ্গিতে একথা বার বার বলা হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছেঃ “এক নিমেষের মধ্যে আমার আদেশ কার্যকরী হয়ে যায়।” [সূরা আল-কামারঃ ৫০] আবার কোথাও বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ তা’আলা যখন কোন বস্তু সৃষ্টি করতে চান, তখন বলে দেনঃ হয়ে যাও।” আর সঙ্গে সঙ্গে তা সৃষ্টি হয়ে যায়।” [যেমন, সূরা আল-বাকারাহঃ ১১৭] এমতাবস্থায় বিশ্ব সৃষ্টিতে ছয় দিন লাগার কারণ কি? তাফসীরবিদ সায়ীদ ইবন জুবাইর রাহিমাহুল্লাহ এ প্রশ্নের উত্তরে বলেনঃ আল্লাহ তা’আলার মহাশক্তি নিঃসন্দেহে এক নিমেষে সব কিছু সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু মানুষকে বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনার ধারাবাহিকতা ও কর্মতৎপরতা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এতে ছয় দিন ব্যয় করা হয়েছে।
(৪) আল্লাহ তা’আলা আরশের উপর উঠেছেন এটা সহীহ আকীদা। কিন্তু তিনি কিভাবে উঠেছেন, কুরআন-সুন্নায় এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য নাই বিধায় তা আমরা জানি না। এ বিষয়ে সূরা আল-বাকারার ২৯নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহকে কেউ استواء সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেনঃ استواء শব্দের অর্থ তো জানাই আছে; কিন্তু এর স্বরূপ ও অবস্থা মানব বুদ্ধি সম্যক বুঝতে অক্ষম। এতে বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। এর অবস্থা ও স্বরূপ জিজ্ঞেস করা বিদ’আত। কেননা, সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ধরনের প্রশ্ন কখনো করেননি। কারণ, তারা এর অর্থ বুঝতেন।
শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা এ গুণে কিভাবে গুণান্বিত হলেন, তা শুধু মানুষের অজানা। এটি আল্লাহর একটি গুণ। আল্লাহ তা’আলা যে রকম, তার গুণও সে রকম। সুফিয়ান সওরী, ইমাম আওযায়ী, লাইস ইবনে সাদ, সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ বলেছেনঃ যেসব আয়াত আল্লাহ্ তা’আলার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এগুলো হক এবং এগুলোর অর্থও স্পষ্ট। তবে গুণান্বিত হওয়ার ধরণের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। বরং যেভাবে আছে সেভাবে রেখে কোনরূপ অপব্যাখ্যা ও সাদৃশ্য ছাড়াই বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত। [এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেখুন, ইমাম যাহাবী রচিত আল-উলু]
(৫) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা রাত্রি দ্বারা দিনকে সমাচ্ছন্ন করেন এভাবে যে, রাত্রি দ্রুত দিনকে ধরে ফেলে। উদ্দেশ্য এই যে, সমগ্র বিশ্বকে আলো থেকে অন্ধকারে অথবা অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসেন। দিবা-রাত্রির এ বিরাট পরিবর্তন আল্লাহর কুদরতে অতি দ্রুত ও সহজে সম্পন্ন হয়ে যায় -মোটেই দেরী হয় না। সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রসমূহকে এমতাবস্থায় সৃষ্টি করেছেন যে, সবাই আল্লাহ তা’আলার নির্দেশের অনুগামী। এতে প্রত্যেক বুদ্ধিমানের জন্য চিন্তার খোরাক রয়েছে। কারণ, এগুলো শুধুমাত্র আল্লাহর আদেশে চলছে। এ চলার গতিতে বিন্দুমাত্র পার্থক্য আসাও অসম্ভব। তবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজেই যখন নির্দিষ্ট সময়ে এগুলোকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করবেন, তখন গোটা ব্যবস্থাই তছনছ হয়ে যাবে। আর তখনই হবে কেয়ামত।
(৬) الخلق শব্দের অর্থ সৃষ্টি করা এবং الأمر শব্দের অর্থ আদেশ করা। বাক্যের অর্থ এই যে, সৃষ্টিকর্তা হওয়া এবং আদেশদাতা হওয়া আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। যেমনিভাবে তিনিই উপর-নীচের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তেমনিভাবে নির্দেশ দানের অধিকারও তাঁর। এ নির্দেশ দুনিয়ায় তাঁর শরীআত সম্বলিত নির্দেশকে বোঝানো হবে। আর আখেরাতে ফয়সালা ও প্রতিদান-প্রতিফল দেয়াকে বোঝানো হবে। [সা’দী]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আয়াতঃ নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেন,[1] অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন।[2] তিনিই দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন; ওদের একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে।[3] আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজিকে, যা তাঁরই আজ্ঞাধীন। জেনে রাখ, সৃষ্টি করা এবং নির্দেশদান তাঁরই কাজ। তিনি মহিমময় বিশ্ব প্রতিপালক।
[1] এই ছয় দিন হল, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার এবং বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। জুমআর দিনেই আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। শনিবারের দিন সম্পর্কে বলা হয় যে, এ দিনে কোন কিছু সৃষ্টি করা হয় নি। এই জন্যই এ দিনকে يوم السبت (শনিবারের দিন) বলা হয়। কারণ, سبت এর অর্থ ছিন্ন করা। অর্থাৎ, এ দিনে সৃষ্টি করার কাজ ছিন্ন বা শেষ ছিল। অতঃপর এই দিনগুলোর মধ্যে কোন্ দিন বুঝানো হয়েছে? আমাদের দুনিয়ার এই দিন, যা সূর্যোদয় থেকে আরম্ভ হয়ে সূর্যাস্ত গেলে শেষ হয়ে যায়? নাকি এ দিন হাজার বছরের সমান দিন? যেভাবে আল্লাহর নিকট দিনের গণনা হয় সেই দিন, না যেভাবে কিয়ামতের দিনের ব্যাপারে আসে সেই দিন? বাহ্যতঃ দ্বিতীয় এই উক্তিই সর্বাধিক সঠিক মনে হচ্ছে। কারণ, প্রথমতঃ সে সময় চাঁদ ও সূর্যের এই নিয়মই ছিল না। আসমান ও যমীন সৃষ্টির পরই এ নিয়ম চালু হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ এটা ঊর্ধ্ব জগতের ব্যাপার যার দুনিয়ার রাত-দিনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কাজেই এই দিনের প্রকৃতার্থ মহান আল্লাহই বেশী ভাল জানেন। আমরা নিশ্চয়তার সাথে কিছু বলতে পারি না। তাছাড়া মহান আল্লাহ তো كُنْ শব্দ দ্বারা সব কিছুই সৃষ্টি করতে পারতেন, তা সত্ত্বেও তিনি প্রতিটি জিনিসকে পৃথক পৃথকভাবে পর্যায়ক্রমে বানিয়েছেন কেন? এরও যুক্তি ও কৌশলগত ব্যাপারে তিনিই সর্বাধিক জ্ঞাত। তবে কোন কোন আলেম এর একটি যৌক্তিকতা সম্পর্কে বলেছেন যে, এতে মানুষকে ধীর-স্থিরতার সাথে শান্তভাবে এবং পর্যায়ক্রমে কার্যাদি সম্পাদন করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আর আল্লাহই অধিক জানেন।
[2] اسْتِوَآءٌ এর অর্থ হল, উপরে ওঠা, সমাসীন হওয়া। সালাফগণ কোন ধরণ নির্ণয় ও সাদৃশ্য স্থাপন ছাড়াই এই অর্থই করেছেন। অর্থাৎ, মহান আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন ও অধিষ্ঠিত। তবে কিভাবে এবং কোন্ ধরনের তা আমরা না বর্ণনা করতে পারব, আর না কারো সাথে তার সাদৃশ্য স্থাপন করতে পারব। নাঈম ইবনে হাম্মাদের উক্তি হল, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করল, সে কুফরী করল এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নিজের ব্যাপারে বর্ণিত কোন কথাকে অস্বীকার করল, সেও কুফরী করল।’’ অতএব আল্লাহ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহর অথবা তাঁর রসূলের বর্ণিত কথাকে বর্ণনা করা সাদৃশ্য স্থাপন করা নয়। কাজেই আল্লাহ সম্পর্কে যে কথাগুলো কুরআন ও হাদীসের আলোকে প্রমাণিত, কোন অপব্যাখ্যা, ধরণ-গঠন নির্ণয় এবং সাদৃশ্য স্থাপন করা ছাড়াই তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরী। (ইবনে কাসীর)
[3] حَثِيْثًا এর অর্থ হল, অতি দ্রুত গতিতে। অর্থাৎ, একটির পর দ্বিতীয়টি দ্রুত চলে আসে। দিনের আলো এলে রাতের অন্ধকার সঙ্গে সঙ্গেই নিঃশেষ হয়ে যায় এবং রাত এলে দিনের আলোও নিভে যায়। ফলে দূরে ও কাছে সর্বত্র কালো অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে।
আয়াত ১০ঃ৩ এর অনুবাদ ও তাফসির নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। নিশ্চয় তোমাদের রব আল্লাহ। যিনি আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে, তারপর আরশে উঠেছেন। তিনি সব বিষয় পরিচালনা করেন। তার অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করার কেউ নেই। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব। সুতরাং তোমরা তাঁর ইবাদাত কর। তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? আল-বায়ান
২। নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক হলেন আল্লাহ যিনি আকাশমন্ডলী আর পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হয়েছেন। তিনি যাবতীয় বিষয়াদি পরিচালনা করেন। তাঁর অনুমতি প্রাপ্তি ছাড়া সুপারিশ করার কেউ নেই। ইনিই হলেন আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। কাজেই তোমরা তাঁরই ‘ইবাদাত কর, তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না? তাইসিরুল
৩। নিশ্চয়ই আল্লাহই হচ্ছেন তোমাদের রাব্ব, যিনি আসমানসমূহকে এবং যমীনকে সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হলেন, তিনি প্রত্যেক কাজ পরিচালনা করে থাকেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করার কেহ নেই; এমন আল্লাহ হচ্ছেন তোমাদের রাব্ব। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদাত কর; তবুও কি তোমরা বুঝছনা? মুজিবুর রহমান
৪। Indeed, your Lord is Allah, who created the heavens and the earth in six days and then established Himself above the Throne, arranging the matter [of His creation]. There is no intercessor except after His permission. That is Allah, your Lord, so worship Him. Then will you not remember? Sahih International
এখন আসুন, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ থেকে আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা দেখা যাকঃ
তাফসীরে জাকারিয়া
আয়াতঃ তোমাদের রব তো আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন (১), তারপর তিনি আরশের উপর উঠলেন (২)। তিনি সব বিষয় পরিচালনা করেন। (৩) তার অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করার কেউ নেই (৪)। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব; কাজেই তোমরা তারই ইবাদাত কর (৫)। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? (৬)
(১) এ আয়াতে তাওহীদকে এমন অনস্বীকার্য বাস্তবতার দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, আসমান ও যমীনকে সৃষ্টি করার মধ্যে অতঃপর সমস্ত কাজকর্ম পরিচালনার মধ্যে যখন আল্লাহ তা’আলার কোন শরীক-অংশীদার নেই, তখন ইবাদাত-বন্দেগী এবং হুকুম পালনের ক্ষেত্রে অন্য কেউ কি করে শরীক হতে পারে? বরং এতে (ইবাদাতে) অন্য কাউকে শরীক করা একান্তই অবিচার এবং সীমালঙ্ঘনের শামিল। এ আয়াতে এরশাদ হয়েছে যে, আসমান ও যমীনকে আল্লাহ তা’আলা মাত্র ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এখানে কি পরিমাণ সময় উদ্দেশ্য তা একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন। যদিও কোন কোন মুফাসসির এ দিনগুলোকে আমাদের বর্তমান দিন এর মত মনে করেছেন। কোন কোন মুফাসসির মত প্রকাশ করেছেন যে, এ দিনগুলো অন্য আয়াতে বর্ণিত, একদিন সমান একহাজার বছরের মত। [ইবন কাসীর]
(২) তারপর বলেছেন (ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ) অর্থাৎ আরশের উপর উঠেছেন। কুরআন এবং হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, আল্লাহ্ তা’আলার আরশ এক প্রকাণ্ড সৃষ্টি আর তা সমস্ত সৃষ্টিজগতের ছাদস্বরূপ। আল্লাহ্ তা’আলা তার আরশের উপর উঠা বাস্তব বিষয়। এটা আল্লাহর একটি মহান কার্যগত গুণ। তিনি যে রকম তার আরশের উপর উঠাও সেরকম। আমরা তার আরশের উপর উঠা কথাটা বুঝি তবে সে উঠার ধরণ আমরা জানিনা। আল্লাহর আরশের উপর উঠা সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা সূরা আল-বাকারায় করা হয়েছে।
(৩) সৃষ্টিজগতের যাবতীয় কর্মকাণ্ড তিনিই পরিচালনা করেন। “আসমানও যমীনের অণু পরিমান বস্তুও তাঁর জ্ঞানের বাইরে নেই।” [সাবাঃ ৩] কোন ব্যাপারে মনযোগ দিতে গিয়ে অন্য ব্যাপার তাঁর বাধা হয় না। [বুখারী] অগণিত আবেদনকারীর আবেদন তাঁর জন্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না। চাওয়ার প্রচণ্ডতায় তিনি বিরক্ত হোন না। বৃহৎ কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে ছোট ছোট বস্তুগুলো তার খেয়ালচ্যুত হয়না। চাই তা সমুদ্রে বা পাহাড়ে বা জনবসতিপূর্ণ এলাকা যেখানেই হোক না কেন। [এ ব্যাপারে আরো দেখুনঃ সূরা হুদঃ ৬, সূরা আল-আনআমঃ ৫৯]
(৪) অর্থাৎ দুনিয়ার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় অন্য কারোর হস্তক্ষেপ করা তো দূরের কথা, কারো আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাঁর কোন ফায়সালা পরিবর্তন করার অথবা করো ভাগ্য ভাঙা-গড়ার ইখতিয়ারও নেই। বড়জোর সে আল্লাহর কাছে দোআ করতে পারে। কিন্তু তার দোআ কবুল হওয়া না হওয়া পুরোপুরি আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহর এ একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার রাজ্যে নিজের কথা নিশ্চিতভাবে কার্যকর করিয়ে নেবার মতো শক্তিধর কেউ নেই। এমন শক্তি কারোর নেই যে, তার সুপারিশকে প্রত্যাখ্যাত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। এ সুপারিশের বিষয়টি আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করেছেন। [দেখুনঃ সূরা আল-বাকারাহঃ ২৫৫, সূরা আন-নাজমঃ ২৬, সূরা সাবাঃ ২৩]
(৫) উপরের তিনটি বাক্যে প্রকৃত সত্য বর্ণনা করা হয়েছিল, অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তোমাদের রব। এখন বলা হচ্ছে, এ প্রকৃত সত্যের উপস্থিতিতে তোমাদের কোন ধরনের কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। মূলত রবুবীয়াত তথা বিশ্ব-জাহানের সার্বভৌম ক্ষমতা, নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব যখন পরোপুরি আল্লাহর আয়ত্বাধীন তখন এর অনিবার্য দাবী স্বরুপ মানুষকে তাঁরই বন্দেগী করতে হবে। [ইবন কাসীর] অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা সেটা বলেছেন, তিনি বলেন, “আর যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছে, তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ। অতঃপর তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে? [সূরা আয-যুখরুফঃ ৮৭) আরও বলেন, “বলুন, সাত আসমান ও মহা-আরশের রব কে? অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ। বলুন, ‘তবুও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না? [সূরা আল-মুমিনুন: ৮৬-৮৭] তাছাড়া সূরা ইউনুসের এ আয়াতের আগের ও পরের আয়াতেও একই বক্তব্য এসেছে।
(৬) অর্থাৎ যখন এ সত্য তোমাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে এবং তোমাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ সত্যের উপস্থিতিতে তোমাদের কি কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে তখন এরপরও কি তোমাদের চোখ খুলবে না এবং তোমরা এমন বিভ্রান্তির মধ্যে ডুবে থাকবে? তোমরা কি তোমাদের অস্বীকার ও গোড়ামীতেই রত থাকবে যে তোমরা মোটেই উপদেশ গ্রহণ করবে না? [আইসারুত তাফাসীর]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আয়াতঃ নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন,[1] তিনি প্রত্যেক কাজ পরিচালনা করে থাকেন।[2] তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশকারী কেউ নেই।[3] ঐ (স্রষ্টা ও পরিচালক) আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর।[4] তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না?
[1] বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সূরা আ’রাফের ৫৪নং আয়াতের টীকা।
[2] অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করে তিনি এমনিই ছেড়ে দেননি, বরং সারা বিশ্ব-জাহানকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন যে, কখনো পরস্পরের মাঝে কোন সংঘর্ষ হয় না। সকল বস্তু তাঁরই নির্দেশে নিজ নিজ কর্মে রত আছে।
[3] মুশরিক ও কাফের – যারা এখানে সম্বোধিত – তাদের বিশ্বাস ছিল যে, যে সকল মূর্তির তারা উপাসনা করে, তারা আল্লাহর নিকট তাদের জন্য সুপারিশ করবে এবং তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, সেখানে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। আর এই অনুমতিও একমাত্র তাদের জন্য দেওয়া হবে, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করবেন। الأنبياء-২৮ (وَلاَ يَشفَعُونَ إِلاَّ لِمَن ارتَضَى)
النجم-২৬) (لا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى)
[4] অর্থাৎ এমন আল্লাহ যিনি বিশ্ব-জগতের স্রষ্টা এবং তার পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। এ ছাড়া সমস্ত এখতিয়ারের পরিপূর্ণ মালিক একমাত্র তিনিই। ফলে একমাত্র তিনিই উপাসনা পাওয়ার যোগ্য।
আয়াত ১৩ঃ২ এর অনুবাদ ও তাফসির নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। আল্লাহ, যিনি খুঁটি ছাড়া আসমানসমূহ উঁচু করেছেন যা তোমরা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে উঠেছেন এবং সূর্য ও চাঁদকে নিয়োজিত করেছেন। এর প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলবে। তিনি সবকিছু পরিচালনা করেন। আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করেন, যাতে তোমাদের রবের সাক্ষাতের ব্যাপারে তোমরা দৃঢ়বিশ্বাসী হতে পার। আল-বায়ান
২। আল্লাহই স্তম্ভ ছাড়াই আকাশমন্ডলীকে ঊর্ধ্বে তুলে রেখেছেন, যা তোমরা দেখছ, অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হয়েছেন তিনিই সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মের বন্ধনে বশীভূত রেখেছেন, প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গতিশীল আছে। যাবতীয় বিষয় তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনি নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী হতে পার। তাইসিরুল
৩। আল্লাহই উর্ধ্বদেশে আকাশমন্ডলী স্থাপন করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত, তোমরা এটা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হলেন এবং সূর্য ও চাঁদকে নিয়মাধীন করলেন; প্রত্যেকে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আবর্তন করে, তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন এবং নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা তোমাদের রবের সাথে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার। মুজিবুর রহমান
৪। It is Allah who erected the heavens without pillars that you [can] see; then He established Himself above the Throne and made subject the sun and the moon, each running [its course] for a specified term. He arranges [each] matter; He details the signs that you may, of the meeting with your Lord, be certain. Sahih International
এখন আসুন, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ থেকে আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা দেখা যাকঃ
তাফসীরে জাকারিয়া
আয়াতঃ আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ উপরে স্থাপন করেছেন খুঁটি ছাড়া(১), তোমরা তা দেখছ।(২) তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন(৩) এবং সূর্য ও চাঁদকে নিয়মাধীন করেছেন(৪); প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলবে।(৫) তিনি সব বিষয় পরিচালনা করেন, আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন(৬), যাতে তোমরা তোমাদের রবের সঙ্গে সাক্ষাত সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার।(৭)
(১) আয়াতের এক অনুবাদ উপরে করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা আসমানসমূহকে কোন খুঁটি ব্যতীত উপরে উঠিয়েছেন, তোমরা সে আসমানসমূহকে দেখতে পাচ্ছ। [তাবারী; কুরতুবী; ইবন কাসীর] অর্থাৎ আল্লাহ এমন এক সত্তা, যিনি আসমানসমূহকে সুবিস্তৃত ও বিশাল গম্বুজাকার খুঁটি ব্যতীত উচ্চে উন্নীত রেখেছেন যেমন তোমরা আসমানসমূহকে এ অবস্থায়ই দেখ। এ অর্থের স্বপক্ষে আমরা পবিত্র কুরআনের অন্যত্র দেখতে পাই সেখানে বলা হয়েছে, “আর তিনিই আকাশকে স্থির রাখেন যাতে তা পড়ে না যায় পৃথিবীর উপর তার অনুমতি ছাড়া।” [সূরা আল-হাজ্জঃ ৬৫] তবে আয়াতের অন্য এক অনুবাদ হলো, আল্লাহ তা’আলা আসমানসমূহকে অদৃশ্য ও অননুভূত স্তম্ভসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ অনুবাদটি ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, হাসান ও কাতাদা রাহেমাহুমুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে। [তাবারী; কুরতুবী; ইবন কাসীর] তবে ইবন কাসীর প্রথম তাফসীরকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
(২) কুরআনুল কারীমের কতিপয় আয়াতে আকাশ দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে; যেমন এ আয়াতে تَرَوْنَهَا বলা হয়েছে এবং অন্য এক আয়াতে (وَإِلَى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ) [সূরা আল-গাশিয়াহঃ ১৮] বলা হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনায় এটা এসেছে যে, যমীনের আশেপাশে যা আছে যেমনঃ বাতাস, পানি ইত্যাদি প্রথম আসমান এ সবগুলোকে সবদিক থেকে সমভাবে বেষ্টন করে আছে। যে কোন দিক থেকেই প্রথম আসমানের দিকে যাত্রা করা হউক না কেন তা পাঁচশত বছরের পথের দূরত্বে রয়েছে। আবার প্রথম আসমান বা নিকটতম আসমানের পুরূত্বও পাঁচশত বছরের পথের দূরত্বের মত। অনুরূপভাবে দ্বিতীয় আসমানও প্রথম আসমানকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করে আছে। এ দুটোর দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথের দূরত্বের মত। আবার দ্বিতীয় আসমানের পুরুত্বও পাঁচশত বছরের রাস্তার মত। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমানও তদ্রুপ দূরত্ব ও পুরত্ব বিশিষ্ট।
এ আসমানসমূহকে আল্লাহ তা’আলা তাঁর নিজস্ব ক্ষমতাবলে কোন প্রকার বাহ্যিক খুঁটি ব্যতীতই ধারন করে রেখেছেন। সেগুলো একটির উপর আরেকটি পড়ে যাচ্ছেনা এটা একদিকে যেমন তাঁর মহা শক্তিধর ও ক্ষমতাবান হওয়া নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে অন্যদিকে আসমান ও যমীন যে কত প্রকাণ্ড সৃষ্টি তার এক প্রচ্ছন্ন ধারণা আমাদেরকে দেয়। [ইবন কাসীর] মহান আল্লাহ বলেন, “মানুষকে সৃষ্টি করা অপেক্ষা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি তো কঠিনতর, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এটা জানে না।” [সূরা গাফেরঃ ৫৭] অন্যত্র আল্লাহ বলেন, “আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং তাদের মত পৃথিবীও, তাদের মধ্যে নেমে আসে তার নির্দেশ; যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।” [সূরা আত-তালাকঃ ১২] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাত আসমান ও এর ভিতরে যা আছে এবং এর মাঝখানে যা আছে তা সবই কুরসীর মধ্যে যেন বিস্তীর্ণ যমীনের মধ্যে একটি আংটি আর কুরসী হলো মহান আরশের মধ্যে তদ্রুপ একটি আংটি স্বরূপ যা এক বিস্তীর্ণ যমীনে পড়ে আছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আর আরশ তার পরিমাণ তো মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ নির্ধারণ করে বলতে পারবে না। [তাবারী]
(৩) এর ব্যাখ্যা সূরা বাকারাহ এবং সূরা আল-আ’রাফে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে সংক্ষেপে এখানে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ আরশের উপর উঠার ব্যাপারটি তাঁর একটি বিশেষ গুণ। তিনি আরশের উপর উঠেছেন বলে আমরা স্বীকৃতি দেব। কিন্তু কিভাবে তিনি তা করেছেন তা আমাদের জ্ঞানের বাইরের বিষয়।
(৪) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা সূর্য ও চন্দ্রকে আজ্ঞাধীন করেছেন। প্রত্যেকটিই একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলে। আজ্ঞাধীন করার অর্থ এই যে, উভয়কে তিনি সৃষ্টিকুলের উপকারের জন্য, তার বান্দাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নিয়োজিত করেছেন, মূলত: প্রতিটি সৃষ্টিই স্রষ্টার আজ্ঞাধীন। [কুরতুবী] যে কাজে তাদেরকে আল্লাহ নিয়োজিত করেছেন তারা অহর্নিশ তা করে যাচ্ছে। হাজারো বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে; কিন্তু কোন সময় তাদের গতি চুল পরিমাণও কম-বেশী হয়নি। তারা ক্লান্ত হয় না এবং কোন সময় নিজের নির্দিষ্ট কাজ ছেড়ে অন্য কাজে লিপ্ত হয় না। [কুরতুবী]
(৫) আয়াতে উল্লেখিত أجل শব্দটির মূল অর্থঃ সময়। তবে অন্যান্য অর্থেও এর ব্যবহার আছে। সে হিসেবে আয়াতের অর্থ বর্ণনায় কয়েকটি মত রয়েছেঃ
এক. এখানে (أَجَلٍ مُسَمًّى) বা সুনির্দিষ্ট মেয়াদ বলতে বুঝানো হয়েছে যে, চাঁদ ও সূর্য কিয়ামত পর্যন্ত তাদের সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে চলতে থাকবে। যখন সূর্যকে গুটিয়ে নেয়া হবে, চাঁদকে নিষ্প্রভ করা হবে, তারকাসমূহ আলোহীন হয়ে পড়বে আর গ্রহ নক্ষত্রগুলো খসে পড়বে, তখন পর্যন্ত এগুলো চলবে। যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ।” [সূরা ইয়াসীনঃ ৩৮] এখানে গন্তব্য বলে সুনির্দিষ্ট সময়ও উদ্দেশ্য হতে পারে। [ইবন কাসীর; কুরতুবী]
দুই. কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতের অর্থ, আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক গ্রহের জন্যে একটি বিশেষ গতি ও বিশেষ কক্ষপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তারা সব সময় নিজ নিজ কক্ষপথে নিধারিত গতিতে চলমান থাকে। চন্দ্র নিজ কক্ষপথ এক মাসে এবং সূর্য এক বছরে অতিক্রম করে। [কুরতুবী]
তিন. অথবা আয়াতের অর্থ, আল্লাহ সেগুলোকে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যস্থানের প্রতি ধাবিত করান। আর সে গন্তব্যস্থান হলো আরশের নীচে। এ ব্যাপারে সহীহ হাদীসে বিস্তারিত এসেছে সূরা ইয়াসীনে যার বর্ণনা আসবে। [ইবন কাসীর]
(৬) অর্থাৎ তিনি আয়াতসমূহকে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। এর মানে, আল্লাহ্ তাআলা অপার শক্তির নিদর্শনাবলী তিনি বর্ণনা করছেন। [বাগভী; ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ তিনি বিস্তারিত প্রমাণ পেশ করছেন যে, যিনি পূর্ব বর্ণিত কাজগুলো করতে পারেন তিনি অবশ্যই মানুষকে মৃত্যুর পর পুনরায় আনতে সক্ষম। [কুরতুবী] এগুলো আরও প্রমাণ করছে যে, তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তিনি যখন ইচ্ছা তখনই তাঁর সৃষ্টিকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন। [ইবন কাসীর]
(৭) অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টজগৎ ও তার বিস্ময়কর পরিচালন-ব্যবস্থা আল্লাহ তা’আলা এজন্য কায়েম করেছেন, যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা করে আখেরাত ও কেয়ামতে বিশ্বাসী হও এবং সত্য বলে মেনে নাও। [বাগভী] কেননা, এ বিস্ময়কর ব্যবস্থা ও সৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য করার পর আখেরাতে মানুষকে পুনর্বার সৃষ্টি করাকে আল্লাহর শক্তি বহির্ভূত মনে করা সম্ভব হবে না।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আয়াতঃ আল্লাহই স্তম্ভ ছাড়া আকাশমন্ডলীকে ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছেন; তোমরা তা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন[1] এবং সূর্য ও চন্দ্রকে বশীভূত করেছেন; প্রত্যেকে নির্দিষ্ট মিয়াদে আবর্তন করে।[2] তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন এবং নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার।
[1] استَوَى عَلَى العَرش এর ভাবার্থ ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এর অর্থ মহান আল্লাহর আরশে অবস্থান করা। হাদীস বিশারদদের তরীকা এটাই যে, তাঁরা আল্লাহর কোন গুণের তা‘বীল (অপব্যাখ্যা) করেন না, যেমন অন্যরা মহান আল্লাহর উক্ত গুণের এবং তাঁর অন্যান্য গুণের অপব্যাখ্যা করে থাকে। হাদীস বিশারদগণ এও বলেছেন যে, তাঁর গুণাবলীর কেমনত্বও বর্ণনা করা যাবে না এবং কোন কিছুর সাথে তুলনাও করা যাবে না। তিনি বলেন: ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ﴾ অর্থ, কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শূরা ১১)
[2] এর একটি অর্থ এই যে, ‘প্রত্যেকে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আবর্তন করবে।’ অর্থাৎ কিয়ামত অবধি আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক চলতে থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ﴾ অর্থাৎ, সূর্য তার স্থির হওয়ার সময় পর্যন্ত চলছে, এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। (সূরা ইয়াসীন ৩৮) দ্বিতীয় অর্থ এই যে, চন্দ্র এবং সূর্য উভয়েই নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তন করছে। সূর্য নিজের চক্র এক বছরে এবং চন্দ্র এক মাসে পূর্ণ করে নেয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ﴾ অর্থাৎ, চন্দ্রের জন্যে আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিনণ কক্ষপথ। (সূরা ইয়াসীন ৩৯) সাতটি বৃহৎ বৃহৎ গ্রহ রয়েছে, ওদের মধ্যে দু’টি হলো সূর্য এবং চন্দ্র। এখানে শুধু উক্ত দু’টি গ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন, কেননা এ দুটিই (মানুষের চক্ষুদৃষ্টিতে) সর্বাধিক বিশাল এবং মহত্বপূর্ণ। এ দুটিও যখন আল্লাহর নির্দেশাধীন, তাহলে অন্যগুলো নিশ্চিতরূপে তাঁর নির্দেশাধীন হবে। আর যখন এরা আল্লাহর হুকুমের অধীনে, তখন এরা মা‘বূদ (উপাস্য) হতে পারে না। মা‘বূদ তো তিনিই, যিনি এদেরকে অধীনস্থ করে রেখেছেন। তাই তিনি বলেন,﴿لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِله الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ﴾ অর্থাৎ, চন্দ্র-সূর্যকে সিজদা করো না, সেই আল্লাহকে সিজদা কর, যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করতে চাও। (সূরা ফুসস্বিলাত ৩৭) অন্যত্র বলেন, ﴿وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ﴾ অর্থাৎ, সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজি সবই তাঁর হুকুমের অনুগত। (সূরা আ‘রাফ ৫৪)
আয়াত ১৬ঃ৫০ এর অনুবাদ ও তাফসির নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। তারা তাদের উপরস্থ রবকে ভয় করে এবং তাদেরকে যা নির্দেশ দেয়া হয়, তারা তা করে।[সাজদাহ] আল-বায়ান
২। তারা তাদের উপরে আল্লাহকে ভয় করে আর তারা তা-ই করে যা তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়। [সাজদাহ] তাইসিরুল
৩। তারা ভয় করে, তাদের উপর পরাক্রমশালী তাদের রাব্বকে এবং তাদেরকে যা আদেশ করা হয় তারা তা পালন করে। [সাজদাহ] মুজিবুর রহমান
৪। They fear their Lord above them, and they do what they are commanded. Sahih International
এখন আসুন, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ থেকে আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা দেখা যাকঃ
তাফসীরে জাকারিয়া
আয়াতঃ তারা ভয় করে তাদের উপরস্থ(১) তাদের রবকে এবং তাদেরকে যা আদেশ করা হয় তারা তা করে।
(১) এ আয়াত এবং এ ধরণের অসংখ্য আয়াত ও হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা’আলা উপরে সুউচ্চে অবস্থান করছেন। তিনি তার আরশের উপর আছেন। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা। এর বাইরের যাবতীয় আকীদা বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
(আয়াতঃ তারা ভয় করে তাদের উপরে তাদের প্রতিপালককে[1] এবং তারা তা করে, যা তাদেরকে আদেশ করা হয়। [2] (সাজদাহ-৩)
[1] আল্লাহর ভয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকে।
[2] আল্লাহর আদেশের অন্যথা করে না বরং যা আদেশ করা হয়, তারা তাই করে। আর যা থেকে নিষেধ করা হয়, তা থেকে তারা দূরে থাকে। (এই আয়াত পাঠ করার পর সিজদা করা মুস্তাহাব। সিজদার আহকাম জানতে সূরা আ’রাফের শেষ আয়াতের টীকা দেখুন।)
আয়াত ১৬ঃ১২৮ এর অনুবাদ ও তাফসির নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। আল-বায়ান
২। যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে আর সৎকর্মশীল, আল্লাহ তো তাদেরই সঙ্গে আছেন। তাইসিরুল
৩। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরই সঙ্গে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎ কর্মপরায়ণ। মুজিবুর রহমান
৪। Indeed, Allah is with those who fear Him and those who are doers of good. Sahih International
এখন আসুন, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ থেকে আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা দেখা যাকঃ
তাফসীরে জাকারিয়া
আয়াতঃ নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা মুহসিন।(১)
(১) এর সারমর্ম এই যে, আল্লাহ্ তা’আলার সাহায্য তাদের সাথে থাকে, যারা দুটি গুণে গুণান্বিত। তাকওয়া ও ইহসান। তাকওয়ার অর্থ হারাম কাজ পরিত্যাগ করা এবং ইহসানের অর্থ সৎকাজ করা। [ইবন কাসীর] অর্থাৎ যারা শরীআতের অনুসারী হয়ে নিয়মিত হারাম কাজ পরিত্যাগ করে, আর সৎকর্ম সম্পাদন করে, আল্লাহ্ তাআলা তাদের সঙ্গে আছেন। বলাবাহুল্য, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার সান্নিধ্য (সাহায্য) অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, তার অনিষ্ট সাধন করার সাধ্য কার? আল্লাহ তা’আলার এ সঙ্গ শুধুমাত্র মুমিনদের জন্য বিশেষভাবে সুনির্দিষ্ট। এ সঙ্গের অর্থ সাহায্য-সহযোগিতা ও তাওফীক দান করা। [বাগভী] নতুবা তিনি আরশের উপরই আছেন। তিনি কারও গায়ের সাথে লেগে নেই। ঈমানদারগণ আল্লাহর সান্নিধ্য ও সঙ্গ দ্বারা ধন্য হওয়ার কথা আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এসেছে। [দেখুনঃ সূরা আল-আনফালঃ ১২, সূরা ত্বা-হাঃ ৪৬, সূরা আত-তাওবাহঃ ৪০, সূরা আস-শু’আরাঃ ৬২] এ ছাড়া আরেক ধরনের সঙ্গ আছে যা আল্লাহর সাথে সমস্ত সৃষ্টির সম্পর্ক। সেটার অর্থঃ তাঁর জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ও শক্তিতে তিনি সবার সাথে আছেন। সবাই তার মুঠোয়। কেউ তার আয়ত্ব ও জ্ঞানের আওতার বাইরে নয়। এ ধরনের সঙ্গ কোন প্রকার সম্মানের বিষয় নয়। এ বিষয়টিও আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ করেছেন। [দেখুনঃ সূরা আল-হাদীদঃ ৪, সূরা আল-মুজাদালাহঃ ৭, সূরা ইউনুসঃ ৬১] [উসাইমীন, আল-কাওয়ায়িদুল মুসলা]
আয়াত ২০ঃ৫ এর অনুবাদ ও তাফসির নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। পরম করুণাময় আরশের ওপর উঠেছেন* । আল-বায়ান
২। ‘আরশে দয়াময় সমুন্নত আছেন। তাইসিরুল
৩। দয়াময় আরশে সমাসীন। মুজিবুর রহমান
৪। The Most Merciful [who is] above the Throne established. Sahih International
* এ আয়াতে আল্লাহর একটি ক্রিয়াবাচক গুণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে استواء বা আরশের উপর উঠা। ইমাম মালেককে এ গুণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, استواء এর অর্থ জানা আছে। তবে তার ধরন (كيفيت) জানা নেই। এর প্রতি ঈমান রাখা ওয়াজিব এবং ধরন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা বিদআত। এ নীতিটি আল্লাহর সকল গুণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এখন আসুন, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ থেকে আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা দেখা যাকঃ
তাফসীরে জাকারিয়া
আয়াতঃ দয়াময় (আল্লাহ) আরশের উপর উঠেছেন,(১)
(১) আল্লাহ্ তা’আলা আরাশের উপর উঠেছেন বলে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন। এর উপর বিশ্বাস রাখা ফরয। তিনি কিভাবে আরাশে উঠেছেন সেটার ধরণ আমাদের জানা নেই। এটা ঈমান বিল গায়েবের অংশ। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা সূরা বাকারার ২৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় করা হয়েছে।
আয়াত ২৫ঃ৫৯ এর অনুবাদ নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। যিনি আসমান, যমীন ও উভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশে উঠেছেন। পরম করুণাময়। সুতরাং তাঁর সম্পর্কে যিনি সম্যক অবহিত, তুমি তাকেই জিজ্ঞাসা কর। আল-বায়ান
২। তিনি আসমান, যমীন আর এ দু’য়ের ভিতরে যা আছে তা ছ’দিনে (ছ’টি সময় স্তরে) সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন। তিনিই রাহমান, কাজেই তাঁর সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস কর যে এ সম্পর্কিত জ্ঞান রাখে। তাইসিরুল
৩। তিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং ওগুলির মধ্যবর্তী সমস্ত কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেন; অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন; তিনিই রাহমান। তাঁর সম্বন্ধে যে অবগত আছে তাকে জিজ্ঞেস করে দেখ। মুজিবুর রহমান
৪। He who created the heavens and the earth and what is between them in six days and then established Himself above the Throne – the Most Merciful, so ask about Him one well informed. Sahih International
আয়াত ৩২ঃ৪ এর অনুবাদ নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীন এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা কিছু আছে, তা ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের জন্য কোন অভিভাবক নেই এবং নেই কোন সুপারিশকারী। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? আল-বায়ান
২। আল্লাহ যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দু’এর মাঝে যা কিছু আছে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন- অতঃপর তিনি ‘আরশে সমুন্নত হন। তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য কোন অভিভাবক নেই, সুপারিশকারীও নেই। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? তাইসিরুল
৩। আল্লাহ, তিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও এতদুভয়ের অন্তবর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক নেই এবং সাহায্যকারীও নেই, তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা? মুজিবুর রহমান
৪। It is Allah who created the heavens and the earth and whatever is between them in six days; then He established Himself above the Throne. You have not besides Him any protector or any intercessor; so will you not be reminded? Sahih International
আয়াত ৫৭ঃ৪ এর অনুবাদ ও তাফসীর নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। তিনিই আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশে উঠেছেন। তিনি জানেন যমীনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু বের হয়; আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়। আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। আল-বায়ান
২। তিনি আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন। তিনি জানেন যা যমীনে প্রবেশ করে, আর যা তাত্থেকে বের হয়, আর যা আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়, আর যা তাতে উঠে যায়, তোমরা যেখানেই থাক তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, তোমরা যে কাজই কর না কেন, আল্লাহ তা দেখেন। তাইসিরুল
৩। তিনিই ছয় দিনে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমাসীন হয়েছেন। তিনি জানেন যা কিছু ভূমিতে প্রবেশ করে এবং যা কিছু তা হতে বের হয় এবং আকাশ হতে যা কিছু নামে ও আকাশে যা কিছু উত্থিত হয়। তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা দেখেন। মুজিবুর রহমান
৪। It is He who created the heavens and earth in six days and then established Himself above the Throne. He knows what penetrates into the earth and what emerges from it and what descends from the heaven and what ascends therein; and He is with you wherever you are. And Allah, of what you do, is Seeing. Sahih International
এখন আসুন, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ থেকে আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা দেখা যাকঃ
তাফসীরে জাকারিয়া
আয়াতঃ তিনি ছয় দিনে আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন; তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি জানেন যা কিছু যমীনে প্রবেশ করে এবং যা কিছু তা থেকে বের হয়, আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়।(১) আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন—তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, আর তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ্ তার সম্যক দ্রষ্টা।(২)
(১) অন্য কথায় তিনি শুধু সামগ্রিক জ্ঞানের অধিকারী নন, খুঁটি-নাটি বিষয়েও জ্ঞানের অধিকারী। এক একটি শস্যদানা ও বীজ যা মাটির গভীরে প্রবিষ্ট হয়, এক একটি ছোট পাতা ও অংকুর যা মাটি ফুড়ে বের হয়, বৃষ্টির এক একটি বিন্দু যা আসমান থেকে পতিত হয় এবং সমুদ্র ও খাল-বিল থেকে যে বাষ্পরাশি আকাশের দিকে উত্থিত হয়, তার প্রতিটি মাত্ৰা তার জানা আছে। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]
(২) অর্থাৎ তোমরা কোন জায়গায়ই তাঁর জ্ঞান, তাঁর অসীম ক্ষমতা, তাঁর শাসন কর্তৃত্ব এবং তাঁর ব্যবস্থাপনার আওতা বহির্ভূত নও। মাটিতে, বায়ুতে, পানিতে অথবা কোন নিভৃত কোণে যেখানেই তোমরা থাক না কেন সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ জানেন তোমরা কোথায় আছো। [ইবন কাসীর] ইমাম আহমাদ রাহেমাহুল্লাহ বলেন, এ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, ‘সম্যক দ্রষ্টা’ যা প্রমাণ করছে যে, আল্লাহ সৃষ্টিজগতের বাইরে থেকেও সবকিছু দেখছেন। তাই এখানে সঙ্গে থাকার অর্থ, সৃষ্টির সাথে লেগে থাকার অর্থ নয়, বরং এর অর্থ হচ্ছে, তোমরা তাঁর দৃষ্টি ও শক্তির অধীন। তাঁর দৃষ্টি ও শক্তি তোমাদের সঙ্গে আছে। [দেখুন: আর-রাদ্দু আলাল জাহমিয়্যাহ ওয়ায যানাদিকাহ: ১৫৪–১৫৮]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আয়াতঃ তিনিই ছয় দিনে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমাসীন হয়েছেন।[1] তিনি জানেন যা কিছু ভূমিতে প্রবেশ করে[2] ও যা কিছু তা হতে বের হয়[3] এবং আকাশ হতে যা কিছু নামে[4] ও আকাশে যা কিছু উত্থিত হয়।[5] তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন,[6] তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ তা দেখেন।
[1] এই অর্থেরই কিছু আয়াত সূরা আ’রাফ ৫৪, সূরা ইউনুস ৩ এবং সূরা আলিফ লা-ম মীম সাজদাহ ৪ প্রভৃতি স্থানে রয়েছে। সেগুলোর টীকা দ্রষ্টব্য।
[2] অর্থাৎ, যমীনে বৃষ্টির যে ফোঁটাগুলো এবং শস্য ও ফল-মূলের যে বীজগুলো প্রবেশ করে, তার পরিমাণ-মাত্রা এবং ধরণ-গঠন তিনিই জানেন।
[3] যে গাছ-পালা, চাহে তা ফলের হোক বা শস্যাদির হোক কিংবা সৌন্দর্য ও সাজের গাছ বা সুগন্ধ ফুলের গাছ হোক, এগুলো যত পারিমাণে ও যেভাবে বের হয়ে আসে, সব কিছুই আল্লাহর জ্ঞানে থাকে। যেমন, অন্যত্র বলেছেন,
{وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلاَّ يَعْلَمُهَا وَلاَ حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الأَرْضِ وَلاَ رَطْبٍ وَلاَ يَابِسٍ إِلاَّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ}
অর্থাৎ, তাঁরই নিকট অদৃশ্যের চাবি রয়েছে; তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে-স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত। তাঁর অজ্ঞাতসারে (বৃক্ষের) একটি পাতাও পড়ে না, মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণা অথবা রসযুক্ত কিম্বা শুষ্ক এমন কোন বস্তু পড়ে না, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই। (সূরা আনআমঃ ৫৯)
[4] বজ্র, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বরফ, বরকত, ভাগ্য এবং সেই সব বিধানাবলী, যা ফিরিশতাগণ নিয়ে অবতরণ করেন।
[5] অর্থাৎ, ফিরিশতাগণ মানুষের যে আমল নিয়ে ওপরে ওঠেন। যেমন হাদীসে আছে যে, ‘‘রাতের আমল দিনের পূর্বে এবং দিনের আমল রাতের পূর্বে আল্লাহর নিকট উঠে যায়।’’
(মুসলিম, কিতাবুল ঈমান)
[6] অর্থাৎ, তোমরা স্থলে থাক বা জলে, রাত হোক অথবা দিন, গৃহে থাক অথবা মরুভূমিতে, প্রত্যেক স্থানে সদা-সর্বদা তিনি তাঁর জ্ঞান ও দর্শন দ্বারা তোমাদের সঙ্গে থাকেন। অর্থাৎ, তোমাদের প্রতিটি কাজকে তিনি দেখেন। তোমাদের প্রতিটি কথা তিনি জানেন ও শোনেন। এই বিষয়টা সূরা হূদের ৫নং এবং সূরা রা’দের ১০নং আয়াত সহ অন্যান্য আয়াতেও বর্ণনা করা হয়েছে।
আয়াত ৬৭ঃ১৬ এর অনুবাদ ও তাফসীর নিন্মে প্রদান করা হলোঃ
১। যিনি আসমানে আছেন,* তিনি তোমাদের সহ যমীন ধসিয়ে দেয়া থেকে কি তোমরা নিরাপদ হয়ে গেছ, অতঃপর আকস্মিকভাবে তা থর থর করে কাঁপতে থাকবে? আল-বায়ান
২। তোমরা কি তোমাদেরকে নিরাপদ মনে করে নিয়েছ যে, যিনি আকাশে আছেন তিনি তোমাদেরকে যমীনে বিধ্বস্ত করে দিবেন না যখন তা হঠাৎ থর থর করে কাঁপতে থাকবে? তাইসিরুল
৩। তোমরা কি নিশ্চিত আছ যে, আকাশে যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদেরকেসহ ভূমিকে ধ্বসিয়ে দিবেননা, আর ওটা আকস্মিকভাবে থর থর করে কাঁপতে থাকবে? মুজিবুর রহমান
৪। Do you feel secure that He who [holds authority] in the heaven would not cause the earth to swallow you and suddenly it would sway? Sahih International
*‘যিনি আসমানে আছেন’ দ্বারা আল্লাহকে বুঝানো হয়েছে। এর দ্বারা আল্লাহ যে আসমানে আছেন, তা প্রমাণিত হয়।
এখন আসুন, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থ থেকে আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা দেখা যাকঃ
তাফসীরে জাকারিয়া
আয়াতঃ তোমরা কি এ থেকে নিৰ্ভয় হয়েছ যে, যিনি আসমানে রয়েছেন(১) তিনি তোমাদেরকে সহ যমীনকে ধ্বসিয়ে দেবেন, অতঃপর তা হঠাৎ করেই থর থর করে কাপতে থাকবে?
(১) এর দ্বারা একথা বুঝায় যে, আল্লাহ উপরে থাকেন। এর সপক্ষে হাজারেরও বেশী দলীল-প্রমাণাদি রয়েছে। মু’আবিয়া ইবন হাকাম আস-সুলামী বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এক দাসীকে খুব জোরে চড় মেরেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাজটাকে নেহায়েত বড় অন্যায় হয়েছে বলে প্ৰকাশ করলেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাকে স্বাধীন করে দেব না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে এস। আমি দাসীটিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে আসলে তিনি দাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আসমানে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, একে মুক্ত করে দাও, এ ঈমানদার। [আবু দাউদ: ৩২৮২]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আয়াতঃ তোমরা কি নিশ্চিত আছ যে, আকাশে যিনি রয়েছেন, তিনি তোমাদেরকে সহ ভূমিকে ধসিয়ে দেবেন না? আর ওটা আকস্মিকভাবে কেঁপে উঠবে। [1]
[1] অর্থাৎ, মহান আল্লাহ যিনি আসমান অর্থাৎ, আরশের উপর সমাসীন। এখানে কাফেরদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে যে, আসমানের সেই সত্তা যখন ইচ্ছা তখনই তোমাদেরকে যমীনে ধসিয়ে দিতে পারেন। অর্থাৎ, যে যমীন তোমাদের বাসস্থান এবং তোমাদের রুযীর উৎস ও ভান্ডার, সেই শান্ত ও স্থির যমীনের মধ্যে মহান আল্লাহ কম্পন সৃষ্টি করে তা তোমাদের ধ্বংসের কারণ বানাতে পারেন।
রেফারেন্সসমূহঃ
[1]. তাফসীর ইবন কাসীর; খণ্ড- ৮-১১, সূরা আরাফ-৫৪
[2]. তাফসীর ইবন কাসীর; খণ্ডঃ ৮-১১, সুরা ইউনুস আয়াত-৩
[3]. তাফসীর ইবন কাসীর; খণ্ডঃ ১৫, সুরা ফুরকান আয়াত-৫৯
[4] . সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[5] . সহীহ মুসলিম
[6] . জামে তিরমিযী
[7] . সহীহ বুখারী, হাদীসঃ ১১৪৫ ; সহীহ মুসলিম, হাদীসঃ ৭৫৮ ; সুনানে আবু দাউদ, হাদীসঃ ১৩১৫
[8] . সুনানে দারেমী, সনদ সহীহ ; আত-তারীখ, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২০২ ; ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ৮৩৮৪
[9] . শারহ আকীদাতিত তাহাবীয়াহ, পৃঃ ৩২২
[10] . ইমাম বাইহাকী এর আল আসমা ওয়া সিফাত, পৃঃ ৫১৫
[11] . ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ১০১
[12] . ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ১২২
[13] . ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ১৫২-১৫৩
[14] . আল-উলু, পৃঃ ১৩২
[15] . মুখতাসার আল-উলু, পৃঃ ২১৩
[16] . মুখতাসার আল-উলু, পৃঃ ১৮৯
[17] . মুখতাসার আল-উলু
[18] . গুনিয়াতুত ত্বলিবীন
[19] . ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল এর আর রা’দ আলা আল জাহমিয়া, পৃঃ ৯২-৯৩